মাকে মনে পড়ে

আহমদ তমিজ : || লেখক : আইনজীবী / সাংবাদিক। ১০:৪৯ পিএম, ৮ মে ২০২১ শনিবার

মাকে মনে পড়ে

রোববার আর্ন্তজাতিক মা দিবস। বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বেভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে লক্ষ কোটি মানুষের অনাবিল ভালবাসায় সিক্ত হয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। মাকে নিয়ে অনেক বিখ্যাত গান, কবিতা ও কালজয়ী উপন্যাস যেমন রচিত হয়েছে তেমনি ভাবে নির্মিত হয়েছে বিখ্যাত চলচ্চিত্রও। অনেক রত্নাগর্ভা মায়ের বিখ্যাত সন্তানরাও মাকে নিয়ে তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভাষায় মূল্যবান মন্তব্য ও করেছেন। মানুষের অভিধানে মায়ের চেয়ে সুমধুর আরেকটি শব্দ আছে কিনা আমার জানা নেই।

আমার মা লালবানু। গায়ের রং র্ফসা, হালকা পাতলা গড়ন সাহসী-তীক্ষè বুদ্ধিমতী, দূরদর্শী ও একজন স্পষ্টভাষী সংসার সচেতন নারী ছিলেন। মা আমাকে কয়েকবার তার জীবনের দুঃখ দহণের দোয়াগুলো চোখের জলে ভাসিয়ে আমাকে শুনিয়ে ছিলেন। আমার মায়েরা চারবোন-চার ভাই। বোনদের মধ্যে মা সবার ছোট। তার সবার বড় বোনটি অর্থাৎ আমার বড় খালা নলুয়া পাড়ার বিখ্যাত শহর আলী সরদারের স্ত্রী। আমার দাদা গোগননগরের বিখ্যাত মোল্লা পরিবারের সদস্য। এলাকার একজন জোতদার ও মাতবর হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। বুড়িগঙ্গা নদীর প্রায় মধ্যখানে তার বিরাট বাড়ি ছিল। তার একমাত্র পুত্র সন্তান অর্থাৎ আমার বাবার জন্য শহরে একটি বনেদী পরিবারের মেয়েকে তার পুত্র বধু হিসেবে খোঁজা হচ্ছিল। ঘটনাক্রমে নলুয়া পাড়ার শহর আলী সরদারের ছোট শ্যালিকা অর্থাৎ আমার মাকে দেখে তার খুবই পছন্দ হয়। কিন্তু মায়ের অভিভাবক শহর আলী সরদার বিয়েতে একটি অদ্ভূত শর্তজুড়ে দিয়ে বললেন, আমার শ্যালিকা গ্রামে থাকতে পারবেনা সেখানে বিজলী বাতি নেই। ভগ্নহৃদয়ে দাদা ফিরে আসার উদ্যোগ নিলে শহর আলী সরদার দাদাকে ডেকে একান্তে বললেন। মাতবর সাব, ছেলেটাকে ঘর-জামাই হিসেবে এখানে রেখে দিন। দাদা অনেকটা বিস্মিত হয়ে বললেন, এটা কি বলছেন, সরদার সাব! আমার বিরাট বাড়ি- ক্ষেত-খামারে ১৫/২০ জন মুনি-কামলা কাজ করে। অনেক মহিলাও বাড়িতে কাজ করে। বৌ মাকে তো কোন কাজ করতে হবেনা। উল্লেখ্য, সে সময়ে বনেদী পরিবারের সন্তানরা শ্বশুর বাড়িতে ঘর-জামাই থাকাটা অনেকটা অপমানজনক বলে মনে করতেন। বিয়ের পর বাবা নলুয়া পাড়ায় আমার নানী বাড়িতেই বসত গড়লেন। এ বাসাতেই আমরা ভাই-বোন মিলে আট জনের জন্ম হয়। আমার পিতা পিয়ার আলী মোল্লা কিছুটা সংসার বিমুখ সুফীবাদে আক্রান্ত মানুষ ছিলেন। দাদার রেখে যাওয়া অনেক জমি জিরাত তিনি বিক্রি করে করে সংসার নির্বাহ করতেন। আমার দেখা মতে, বাড়ি থেকে মসজিদ এবং মসজিদ থেকে বাড়ি ছিল তার বিচরণ ক্ষেত্র। মন খারাপ হলে মসজিদে বসে উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। ফলে মাকে এতগুলো সন্তান নিয়ে সংসার নামক বিরাট বস্তাটি একাই সামাল দিতে হলো।

স্বাভাবিক ভাবে যে বয়সে একজন ছেলে বা মেয়ে চতুর্থ শ্রেনিতে পড়ে অথচ সে বয়সে আমার বর্ণ পরিচয় ঘটেনি। আমি ছিলাম মাতৃভক্ত এক নির্বোধ বালক। আমাদের সমাজ সংসারে দুষ্ট ছেলে ও নির্বোধ ছেলেদের প্রতি মায়েদের যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হতো। একইভাবে তারা কিছুটা উদ্বিগ্ন ও থাকতেন। দুষ্টু ছেলেটা কোথায় কখন কি করে বসে, আর নির্বোধ ছেলেটা কখন বাড়ি ফেরে সারাটা দিন কোথায় ছিল, কি খেয়েছে এমন হাজারটা চিন্তা আমার মাকে আতঙ্কিত ও চিন্তাগ্রস্ত করে রাখত। বলতে দ্বিধা নেই, আমি ছিলাম দ্বিতীয়টি অর্থাৎ মায়ের নির্বোধ ছেলে।

আমার মা তার বড় দু’ ছেলেকে আত্মীয়-স্বজনদের চরম অসহযোগীতা ও বিরাট প্রতিকূল পরিবেশে কিভাবে ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন যে দুঃসহ কষ্ট ও বেদনা মথিত দিনগুলোর কথা তিনি আমাকে শুনিয়ে ছিলেন। কিন্তু মা কেন জানি আমাকে ব্যবসা-পাতি থেকে দূরে রেখে একান্ত লেখাপড়ার দিকে ঠেলে দিয়ে ছিলেন।

১৯৬৭ সালে আমি মেট্রিক পরীক্ষায় অবর্তীন হলাম। আমার ঘনিষ্ঠ আত্নীয়দের মধ্যে আমার বড় খালার বড় নাতি নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ খোকা মহিউদ্দিনের ছোট ভাই ডিপটি, তার বড় বোনের ছেলে জিল্লুর ও আমার অপর খালাতো ভাই, মামাতো ভাইসহ মোট আটজন পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলাম। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে আমি ও আমার বড় লোক দুই আত্নীয়সহ চারজন উর্ত্তীণ হলাম। আমার সেই মামাতো ও খালাতো ভাইদের কেউ পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে পারলো না। সারা মহল্লা ও পাড়াজুড়ে বিশেষ করে আমাকে নিয়ে বেশ কৌতুহল সৃষ্টি হল। সারাদিন একা একা ঘুরে বেড়ানো এই নির্বোধ ছেলেটা কখন লেখাপড়া করে পরীক্ষা দিয়েছে একমাত্র আমার মা ছাড়া কারোরই খোঁজ ছিলনা।

মার একটি পুরনো অসুখ ছিল। কেউ বলতেন, পেট ব্যথা, কেউ বলতেন, কলিজা বেদনা, কয়েক মাস পর পর অসুখটি দেখা দিতো। সে সময় মা বুকে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতেন। তার শরীর ক্রমশ-জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমার মেঝো ভাই, সে মাকে শহরের নামী-দামী ডাক্তার দেখাতেন। এদের মধ্যে সে সময়ের নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত ডাক্তার আবদুস সামাদ খাঁন ও ছিলেন। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হতো। শেষের দিকে তিনি এসেও ভিজিট নিতে চাইতেন না। বলতেন ভিজিট নিয়ে কি হবে অনেক দিন ধরে তাকে চিকিৎসা দিচ্ছি তাকে তো সুস্থ করতে পারলাম না। সে সময়ে দেশে আলট্রসনোগ্রাম মেশিনের অস্তিত্ব ছিলনা। একদিন কলেজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি অসুস্থ মা ইশারায় আমাকে তার বিছানার কাছে ডেকে নিলেন। আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, তুমি জীবনে ধনী হতে পারবে না। তবে আল্লাহ তোমাকে কখনও অর্থ কষ্টে রাখবেন না। আমি তোমাকে দোয়া করে গেলাম। সব সময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে। কখনও মানুষকে কষ্ট দিবেনা। মিথ্যা বলবেনা। বুঝতে পারলাম মার অস্তিম সময় ঘনিয়ে আসছে।

পুনশ্চ ঃ- অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী বাঙ্গালি অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন বিদেশ থেকে টেলিফোনে এ ‘গর্বিত’ খবরটি তার মাকে জানালে উত্তরে মা তাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিলেন বাবা তুমি খেয়েছো? এ হচ্ছে শ্বাশ্বত মায়ের প্রকৃত রূপ। সবশেষে গীতিকার খান আতার ভাষায়”মায়ের মতো আপন কেহ নাইরে/ মা জননী নাইরে যাহার/ ত্রিভূবণে তাহার কেহ নাইরে।

 


বিভাগ : আমার আমি


নিউজ নারায়ণগঞ্জ এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আরো খবর
এই বিভাগের আরও