ভাস্কর্যের পর নরেন্দ্র মোদী, এরপর কি ?
|| ০৫:০৭ পিএম, ২৭ মার্চ ২০২১ শনিবার

“শুনলাম আগামী মাসেই দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া হচ্ছে। আরো শুনলাম পরাশক্তি আমেরিকা চায় এই নির্বাচনের সকল দেখভালের দ্বায়িত্বে থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এবার যা শুনলাম! আক্কেল গুড়ুম। চলমান আন্দোলনের কারণে অপমান বোধ করায় মোদী’জি চান বিএনপি-জামাত-বাম জোট ক্ষমতায় আসুক”।
আগের ৪টি লাইনের পুরোটাই কাল্পনিক ভাবনা। কিন্তু যে প্রশ্ন মনে জেগেছে সেটি পুরোপুরি বাস্তব, আর তা হলো যদি সত্যিই এমন হয় তবে এই হেফাজত, বাম, জামাতীরা কি তখনও মোদীর বিরুদ্ধে মসজিদে, রাস্তায় আন্দোলন করবেন? মোদীর কুশপুত্তলিকা দাহ করবেন ?? মোদীকে ইসলামের শত্রু বলে নির্বাচন বয়কট করবেন ??? উত্তরটা দেবো, তবে শেষে।
এবার আসি প্রাসঙ্গিক ভাবনায়। সময়টা ২০১৫ সালের ৬ জুন। প্রথমবারের মত বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তখন কোন হৈ চৈ ছিলনা, পরিবেশটা ছিল সুন্দর। অথচ সেই সফরটি ছিল রাজনৈতিক সফর। সেই নরেন্দ্র মোদী প্রায় ৬বছরের মাথায় দ্বিতীয় বারের মত বাংলাদেশে আসায় আন্দোলনের নামে সংঘাত হচ্ছে। অথচ এবার উনি এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্রের প্রধান হিসিবে আমন্ত্রিত হয়ে। যখন এটা নিশ্চিত ছিল যে তিনি আসবেন এবং ২দিন পর চলেও যাবেন, তাহলে কেন এই রণ নীতি?
আরো একটু আগে ফিরে যাই। আওয়ামীলীগ ক্ষমতাকালে বাংলাদেশে এসেছিলেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল মোদীর আগমনে নেয়া নিরাপত্তাকে কারফিউ (!) হিসেবে তুলনা করেছেন। অথচ তখন এর চেয়েও বেশী নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছিল রাজধানী। সেই অবস্থাতেও হোটেল সোনারগায়ে বিল ক্লিনটনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এই প্রসঙ্গে বেশী কিছু আর বলতে চাই না। তবে মূল কথায় ও বর্তমান চলমান প্রেক্ষাপট নিয়েই কথা বলি।
২দিন পর মোদীও এদেশে থাকবেন না আর ইস্যুও থাকবে জেনেও কেন এবার নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে এত গাত্রদাহ ও আন্দোলন? আসলেই কি মোদী বিরোধী আন্দোলন নাকি স্বাধীনতার ৫০বছর পূর্তিতে পাকিপ্রেমীদের অন্ত:জ্বালা? নাকি সেই ভাস্কর্য ইস্যূতে ফেল মারা গোষ্ঠী এবার এই ইস্যুতে কিছু একটা ঘটিয়ে দিতে চাইছে? এমন প্রশ্নের মত অনেক প্রশ্নই আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
মোদীর আগে ঘুরে গেলেন শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট। যে শ্রীলঙ্কা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধীতায় ছিল আর পাকিস্তানের সাথে ছিল পরম মিত্রতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারতীয় আকাশ সীমা ব্যবহার করতে পারতো না। তখন শ্রীলঙ্কার আকাশ ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগর দিয়ে যাওয়া আসা করতো। কই ?? এনিয়ে তো কোন বাধা বিপত্তি দেখা গেল না।
রাজাকার-আল বদর প্রধানদের ফাঁসির দন্ড কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে শোক প্রস্তাব দেয়া হয় পাকিস্তানের সংসদে। কই! এনিয়ে তো বিএনপি-জামাত কিংবা সুশীলের ধ্বজ্জাধারী বামপন্থীদের মুখে কোন রা দেখা যায়নি। আর হেফাজত তো কিছু বলবে না এটাই স্বাভাবিক।
আগুন সন্ত্রাসের নামে শত শত মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। কই! এনিয়ে তো বামপন্থী সুশীলরা আজ অবধি একটি কথাও বলেনি। যারা মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিয়ে ফ্যানা তুলে পার্টি অফিসে গিয়ে বিরিয়ানী খান!
সৌদিয়ানরা কত হাজার ইয়ামেনী হত্যা করেছিল তার সঠিক হিসাব নেই। সেই সৌদি যখন এই নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রন জানিয়ে রাজপ্রাসাদে বুকে বুক মিলিয়েছিল তখন কোথায় ছিল হেফাজতের ঈমানী আন্দোলন? মুসলিম বিশ্বে যাকে অন্যতম নেতা মনে করা হয় সেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান যখন এই মোদীর সাথে বুকে বুক মিলিয়েছেন তখন কোথায় ছিল হেফাজতীদের ঈমানী লড়াই!!!
আসলে ভাস্কর্য ইস্যু চরমভাবে ফেল মারায় মোদীর আগমনকে বেছে নেয়া হয়েছিল সেই নীল বা বেগুনি যাই বলি না কেন, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই। লাশ চাই , লাশ চাই। যাতে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেটিকে তুলে ধরা যায় মুসলিম নির্যাতন আর প্রতিবাদকে দাবিয়ে রাখতে সরকারের নেগেটিভ পারসেপশন হিসেবে। তবে এবার একটু মাথা খাটাতে হয়েছে, বোধ করি টাকা-কড়িও একটু বেশি খরচা হয়েছে দেশী ও বিদেশী প্রভুদের। এবার কিন্তু তেলে-জলে মিশ খাওয়ানো হয়েছে। মানে বাম যদি তেল হয় তবে হেফাজত পানি। আমরা দেখলাম নরেন্দ্র মোদী ইস্যুতে হেফাজত, জামায়াত-শিবির ও বামপন্থীদের এক অনন্য ‘মিক্সড শরবত’ বিক্রির চেষ্টা চালানো হলো যেভাবে বিট লবন কোন পানীয়র তলানীতে থাকলেও তার নির্যাস ঠিকই পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি এই অনন্য শরবতে বিট লবনের দ্বায়িত্ব পালন করলো বিএনপি। তবে এই নানা সহিংস ও হতাহতের ঘটনার ছবির পাশাপাশি একটি ছবি বেশ আন্দোলিত করেছে আমাকে। জাতির জনকের মুর্যালে আগুন ধরিয়ে ভাংচুর করার দৃশ্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ঘটনা যখন ঘটছিল তখন রেলস্টেশনটিও জ্বালিয়ে দিলো উগ্র মৌলবাদীরা।
শুরু থেকেই বলার চেষ্টা করছি যে, চলমান আন্দোলন কোন মোদী বিরোধী আন্দোলন নয়। উগ্র মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী আর অসাম্প্রদায়িকতার শ্লোগান তোলা চেতনা ব্যবসায়ীরা মোদী ইস্যু নিয়ে মাঠে নেমেছে মূলত পরাজয়ের ৫০বছর পূর্তিতে অন্ত:জ্বালা দেখানোর জন্য। বঙ্গবন্ধুর মুর্যালে যে অসম্মান দেখানো হয়েছে সেটি এরই বহি:প্রকাশ। নরেন্দ্র মোদী গুজরাট দাঙ্গার নেপথ্য নায়ক ছিলেন কিনা এটা সেদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে মোদী ২বার ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
নরেন্দ্র মোদী প্রতিনিধিত্ব করছেন ভারতকে, যে ভারত সাহায্য না করলে আজ আমি আপনি কোন পাকিস্তানীর বাসায় মালি কিংবা কুলির কাজ করতাম। মুসলমান হত্যার জন্য যদি ঘৃনা করতেই হয় তবে আগে পাকিস্তানকে করো। ১৯৭১ এ ৩০লাখ মানুষকে যারা হত্যা করেছে যাদের ৯০ভাগই ছিলো মুসলমান। ধিক্কার জানাতে হয় তাহলে সৌদি আরব এবং ইরানকে জানাও যে দুই দেশ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য লাখ লাখ ইয়ামেনি মুসলিমদের হত্যা করেছে। আপনাদের যদি এতই ধর্মের প্রতি টান থাকে তাহলে ভারতীয় মুসলমানরা কি দোষ করল? বার্মায় যখন মুসলিমদের গনহত্যা করা হচ্ছিল তখন আপনার পাকিস্তান কোথায় ছিল? যখন মাদার অব হিউম্যানিটি খ্যাত জননেত্রী শেখ হাসিনা বার্মার নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বকে আরেকটি গণহত্যার মিছিল থেকে বাঁচালেন আপনারাই তখন কই ছিলেন? আপনার পাকিস্তান কই ছিল? হেফাজতীরা ঢাল হিসেবে মসজিদকেই শুধু ব্যবহার করে তা কিন্তু না। আমি দেখেছি মামলার হাজিরা দিতে এসে কোমলমতি মাদ্রাসার ছাত্রদের হাতে পবিত্র কোরআন শরীফ দিয়ে এজলাসে, কোর্টে আসতে।
এখন একেবারে প্রথম প্রশ্নগুলোর উত্তরটা দেই। হ্যাঁ, এই মোদীকেই মাথায় তুলে নাচবে এই ককটেল শরবতের শরবতীরা। যদি কোনভাবে টের পায় ক্ষমতায় আওয়ামীলীগ থাকবে না। তখন মোদী হবে ইসলামের ত্রানকর্তা !!! ভাস্কর্য, মোদী.. .. এরপর কি ইস্যু নিয়ে বিদেশী অর্থায়নের তারা মাঠে নামে সেটার অপেক্ষায় রইলাম।