সিদ্ধান্তহীনতা আর আমলাতন্ত্রে সেন্ট্রাল অক্সিজেন
রাজু আহমেদ || ১০:৫৭ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০২১ সোমবার

ঘটনা ঘটবার পর ‘তোলপাড়-তোরজোড়’ শুরু হওয়াটা আমাদের দেশে একটি স্বাভাবিক নিয়মে দাড়িঁয়েছে। ঠিক তেমনি কিছু দিন গত হলেই সেই ‘তোলপাড়-তোরজোড়’ ধীরে ধীরে ‘মন্থর-কচ্ছপ’ গতি প্রাপ্ত হওয়াটাও নিয়ম হয়ে গেছে। যে অতিমারী কোভিড পুরো বিশ^কে থামিয়ে দিয়েছে সেই কোভিড নিয়েও অনেকটা এই নিয়মকে অনুসরণ করেছে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়। ঠিক যেমনটি হয়েছে কোরানার সাথে যুদ্ধ করার প্রধান হাতিয়ার ‘অক্সিজেন প্ল্যান্ট’ নিয়ে। আরো ৭মাস আগেই সারা দেশের ৭৯টি হাসপাতালে নিরবিচ্ছন্ন অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কথা থাকলেও এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সিদ্ধান্তহীনতা আর ‘মন্থর-কচ্ছপ’ গতি অনুসরণ করা হয়েছে। অথচ শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯-এর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ। যত রোগী এযাবৎকালে মৃত্যু বরণ করেছেন তাদের ৯০ ভাগই মারা গেছেন এই অক্সিজেনের অভাবেই। অথচ নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেন থাকলে প্রয়োজন হয়না ভেনটিলেশনেরও।
নিরবিচ্ছন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশের প্রতিটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বিদেশী সংস্থার টাকায় তৈরী হতে যাওয়া অক্সিজেন প্যøান নিয়ে সংশ্লিষ্টরা হিমশিম (!) খেয়েছেন শুধুমাত্র তালিকা তৈরী করতে! অবাক করা বিষয় হলো শুধুমাত্র ৯টি হাসপাতাল দুটি তালিকায় থাকায় নুতন করে তালিকা পরিশুদ্ধ করতেই মন্ত্রনালয় সময় নিয়েছে ৪মাস! কারণ, গত বছর করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের কাজে তোড়জোড় শুরু হলেও সংক্রমণের হার কমে এলে কাজের গতিও কমে যায়। চলতি বছর ২য় ঢেউ শুরু হলে আবারো সেই তোরজোড় শুরু হয়েছে এই প্রকল্প সম্পন্ন করতে। এই সময়টাতে শুধুমাত্র নিরবিচ্ছন্ন অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন কয়েকশ রোগী।
জানা গেছে, বৈশ^য়িক এই মহামারীতে করোনা রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপন করতে গত বছরের ৫ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চিঠিতে অধিদপ্তর জানায়, করোনা মহামারির কারণে ক্রমেই রোগী বাড়তে থাকায় বিদ্যমান মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইন সিস্টেম দ্বারা অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে ট্যাংক স্থাপন প্রয়োজন। এরপর চলে গেছে প্রায় ১১ মাস। এখন আবার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অক্সিজেন সরবরাহের কাজে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। দাবী উঠেছে, নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারার পেছনে যাদের গাফিলতি আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন সূত্র বলছে, গত বছরের মে মাসে সারা দেশে ৭৯টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট (নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা) বসানোর পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয় জুনে। বৈশ্বিক মহামারি শুরুর পর অনেক দেশ দ্রুততার সঙ্গে এমন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও বাংলাদেশ সরকার শুরুতেই জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে এমন একটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে একটি ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি। এবছর করোনার ২য় ঢেউ বা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। জানা গেছে, ৭৯টির মধ্যে ২৬টি হাসপাতালে প্ল্যান্ট বসানোর কাজ পায় ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি)। সিদ্ধান্তহীনতায় বাকি ৫৩টি হাসপাতালের কার্যাদেশ ঝুলে যায়। অবাক করা বিষয় হলো, মাঝে সংক্রমণ কমে আসায় অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ বাদ দেওয়ার উপক্রমও হয়েছিল। কিন্তু গত শীতে সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কায় গত বছর অক্টোবরে আবার তোরজোড় শুরু হলে তড়িঘড়ি করে এসব হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালের তালিকা নির্ধারণ নিয়ে শুরু হয় দীর্ঘসূত্রতা।
যতদূর জানা গেছে, ৩০টি হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কাজ করছিলো নিমিউ অ্যান্ড টিসি। এর মধ্যে ২৮টির কাজ শেষ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠান। ২১টিতে ইতিমধ্যে অক্সিজেন সরবরাহ চালু হলেও বাকি ৭টি ঝুলে আছে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে। পাশাপাশি ঢাকার বাইরে ১৯টি হাসপাতালে গ্যাস পাইপলাইন ও লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের কাজ পেয়েছে আরেকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (এইচইডি)। এর মধ্যে ছিল ৯টি ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও ১০টি ১০০ শয্যার হাসপাতাল। দুই দফায় ঢাকার বাইরের ১৯ জেলায় ১৯টি সদর হাসপাতালে কাজ করার অনুমোদন পায় এইচইডি। এর মধ্যে ১৭টি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ চালু হয়েছে। আর দিনাজপুর জেনারেল ও ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে কাজ শেষের দিকে বলে জানা গেছে।
তবে জাতিসংঘের অধীনে থাকা ইউনিসেফ এর ৩০টি আক্সিজেন প্ল্যান্ট এর মধ্যে একটিও চালু হয়নি এখনও। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গঠিত কোভিড তহবিলের টাকায় ৩০টি হাসপাতালে গ্যাস পাইপলাইন ও লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপন করবে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বাংলাদেশ। গত বছরের জুনে এমন সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হলেও তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চূড়ান্ত অনুমোদন পায় অক্টোবরে। এরপর শুরু হয় হাসপাতালের তালিকা নিয়ে জটিলতা। তাদের তালিকায় থাকা কিছু হাসপাতালে কাজ করার প্রস্তুতি নেয় নিমিউ ও এইচইডি। তাই তালিকা সমন্বয় করতে চলে গেছে প্রায় ৪ মাস। চলতি বছরে তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করে তালিকা চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জানা গেছে, গত বছর জুনেই যদি চুড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যেত তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউনিসেফের ৩০টি অক্সিজেন প্ল্যান্টই চালু হতো। তবে এই গাফিলতি আরফ ফাইল চালাচালির মধ্যেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যে ৬২টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কিছু বিষেশায়িত হাসপাতালও আছে।
অপরদিকে করোনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, হাজার কোটি প্রনোদনা দেয়ার আগে প্রয়োজন ছিল পুরো দেশে অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা। বিশেষ করে ইউনিসেফের অর্থায়নে যে ৩০টি প্ল্যান্ট বসানোর কথা ছিল গত বছরই, সেগুলোকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কয়েক মাস আটকে রাখাটা আত্মহত্যার সামিল হয়েছে। কয়েক মাস আগে এই অক্সিজেন প্ল্যানগুলো তৈরী হলে হয়তো অনেকগুলো জীন বেঁচে যেত।
তবে সামনের সময়টা অনেক বেশী খারাপ হওয়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আফ্রিকান আর ইন্ডিয়ান ফেরিয়েন্ট ইতমধ্যেই দেশে প্রবেশ করেছে। একমাত্র মহান আল্লাহই পারেন এখন এদেশকে আক্রান্তের সুনামি থেকে রক্ষা করতে। আর যদি কোন অলক্ষন ঘটে তবে এই সেন্ট্রাল অক্সিজেনের সিদ্ধান্তহীনতা আর আমলাতন্ত্রের কারণে হাজারো প্রাণ হবে করোনার বলি...