স্কুলের দখল ছাড়লো আনসার প্রশিক্ষণার্থীরা
স্টাফ করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ১০:৪৭ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ শুক্রবার

নিউজ নারায়ণগঞ্জ ডটকম ও দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জে সংবাদ প্রকাশের পরে অবশেষে নারায়ণগঞ্জ শহরের কিল্লারপুলস্থ ৩৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার জুনিয়র হাই স্কুলের দখল ছেড়েছে প্রশিক্ষণার্থী আনসার সদস্যরা। বৃহস্পতিবার সকালেই প্রশিক্ষণার্থী আনসার সদস্যরা তাদের সামগ্রী নিয়ে স্কুল ভবন ত্যাগ করে। তবে প্রশিক্ষণার্থী আনসার সদস্যরা স্কুল ত্যাগ করলেও এখনো অনিশ্চিত নারায়ণগঞ্জ শহরের কিল্লারপুলস্থ ৩৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। আড়াই বছর পূর্বে হাইকোর্টের রুল জারি এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের হস্তক্ষেপে জুনিয়র হাইস্কুলটি খুলে দেওয়া হলেও সেটি মানেনা ড্রেজার পরিদপ্তরের কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে স্কুলটির নামে জমিসহ স্থাপনা সরকার তথা এমপি সেলিম ওসমানকে বুঝিয়ে না দেওয়ায় এমপি সেলিম ওসমান এবং জেলা প্রশাসনও কোন ধরনের দায়িত্ব নিতে পারছেনা।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারীতে ৩৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ড্রেজার জুনিয়র হাইস্কুলটি আকস্মিক বন্ধ ঘোষণার পরে শিক্ষাজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল প্রায় ৩শ’ শিক্ষার্থীর। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারী ৩৩ বছরের স্কুলটি হঠাৎ করে বন্ধের কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। দুই সপ্তাহের মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ও নারায়ণগঞ্জের ড্রেজার অধিদফতরের প্রধান প্রকৗশলীকে এ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেন। পাশাপাশি মামলার পরবর্তী আদেশের জন্য ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ রাখা হয়েছিল। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের স্কুলটি বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে মামলা বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেছিলেন রিটকারী ব্যারিস্টার কাজী আখতার হোসাইন। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার মহিউদ্দিন মো. হানিফ ফরহাদ ও এ এইচ এম রেহানুল কবীর রনি। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
এদিকে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরে হাইকোর্টের রুল জারি এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের হস্তক্ষেপে ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার পরিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শামসুদ্দিন আহমদ স্কুলটির শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে তালা খুলে দেন। সেসময় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শামসুদ্দিন আহমদ বলেন, স্কুলটি বন্ধ হোক সেটা আমি কখনোই চাইনি। কিন্তু নীড বেইসড সেটআপে ড্রেজার পরিদপ্তরের স্কুলটি অর্ন্তভুক্ত না হওয়ার কারণে আমার কিছুই করণীয় ছিলনা। যা কিছুই করা হয়েছে সেটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই হয়েছে। আমি শুধু নির্দেশ পালন করেছি। এখানে আমার কিছু করণীয় ছিলনা। আমি চাই স্কুলটি যাতে সঠিকভাবে চলে। এক্ষেত্রে আমি পূর্ণ সহযোগিতা করবো। তিনি আরো বলেন, পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা স্কুলটি পুণরায় চালু করার জন্য বলেছেন। স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান মহোদয়ের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। আমি তাকে আশ্বস্ত করেছি স্কুলটি পুণরায় চালু হবে।
পরে ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারী স্কুলটি পরিদর্শনে আসেন নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর ও বন্দর) আসনের সংসদ সদস্য ও বিকেএমইএ’র সভাপতি সেলিম ওসমান। সেসময় সেলিম ওসমান জানিয়েছিলেন স্কুলটি আগে ড্রেজার পরিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি দেখিয়ে স্কুলটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাবান্ধব। যেহেতু শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজন্যই আমার এখানে আসা। পরে স্কুলটি খুললেও স্কুলটি কিভাবে চলবে কারা পরিচালনা করবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনা ছিলনা। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের ড্রেজার কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের কাছে লিখিত দায়িত্ব দেয় তাহলে আমি (সংসদ সদস্য) ও জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা মিলে যৌথভাবে সভা করে সিদ্ধান্ত নিবো। সেক্ষেত্রে স্কুল ও এর সামনের মাঠটি সহ স্কুলের জন্য লিখিতভাবে বরাদ্দ দিতে হবে। যে কারণে আমরা কাছে আবেদন জানিয়েছি স্কুলটি যদি তারা পরিচালনা করতে না পারে তাহলে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসনকে স্কুলটি পরিচালনায় লিখিত অনুমতি দেয়া হোক। কারণ স্কুলটি অত্যাধুনিকভাবে চালাতে হলে লিখিত সম্মতিটা জরুরীভাবেই দিতে হবে।
এদিকে করোনা মহামারীর কারণে সরকার যেখানে দেড় বছর পরে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সেখানে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার পরিদপ্তরের কর্তৃপক্ষ স্কুলটির শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণার্থী আনসারদের বাসস্থানের জন্য অনুমতি দিয়েছে। চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয় সরকার। সে অনুযায়ী ড্রেজার জুনিয়র হাইস্কুলটিও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে পাঠদান চালু করেন শিক্ষকরা। তবে ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পরে ড্রেজার জুনিয়র হাইস্কুলটির দ্বিতীয় তলার ৪টি শ্রেণিকক্ষে অবস্থান নেয় প্রশিক্ষনার্থী আনসার সদস্যরা। ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে স্কুলটির শিক্ষক শিক্ষার্থীরা স্কুলে এসে দেখতে পান তাদের স্কুলের সামনে প্রশিক্ষনার্থী আনসার সদস্যরা কুচকাওয়াজ করছে। দ্বিতীয় তলার ৪টি শ্রেণিকক্ষের সকল বেঞ্চ টেবিল শ্রেণিকক্ষের বাইরে বারান্দায় রেখে প্রশিক্ষণার্থীদের বাসস্থান বানানো হয়েছে। এছাড়া স্কুলটির বেশ কিছু টেবিলে ও বেঞ্চও অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল চালুর পরে ২য় শ্রেণি থেকে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে এসেছে। তবে ড্রেজারের প্রধান ফটকে দাড়িয়ে থাকা আনসার সদস্যরা শিক্ষার্থীদের দেখলেই বলে তোমার স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হবে অন্যত্র চলে যাও। যে কারণে অনেক শিক্ষার্থীই এখন অন্যত্র চলে যাচ্ছে। স্কুলটিতে ৬টি শ্রেণিকক্ষের মধ্যে দ্বিতীয় তলার ৪টিতে বর্তমানে আনসার প্রশিক্ষণার্থীদের দখলে। যে কারণে ২টি শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে ক্লাস করাতে হচ্ছে। পাশাপাশি আনসার প্রশিক্ষণার্থীরাও মাস্ক ছাড়াই অবাধে ঘোরাফেরা করছে। এতে তাদের যেমন পাঠদান ব্যহত হচ্ছে তেমনি শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার পরিদপ্তরের এডি রবিউল ইসলাম দাবি করেন হাইকোর্ট স্কুল খুলে দেওয়ার কোন নির্দেশনা দেয়নি। হাইকোর্ট তাদের কাছে স্কুলটির বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। তারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কিন্তু সেই রুলের নিস্পত্তি এখনো হয়নি। এছাড়া নীড বেইসড সেটআপে ড্রেজার পরিদপ্তরের স্কুলটি অর্ন্তভুক্ত হয়নি। এখানে শিক্ষকদের কোন পদও নেই। যে কারণে আমরা স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দিতে পারিনা। এই স্কুলে ড্রেজার কলোনীর কোন ছাত্র ছাত্রী অধ্যয়ন করেনা বিধায় ২০১৮ সালে কর্তৃপক্ষ স্কুলটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমরা সেই সিদ্ধান্তের আলোকেই কাজ করছি। ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী স্কুলটি খুলে দেওয়ার সময়ে এমপি সেলিম ওসমান স্কুলটির দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাকে কেন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি এ বিষয়ে জানতে চাইলেও তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহরের কিল্লারপুলস্থ ৩৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার জুনিয়র হাইস্কুলটি বন্ধের পাঁয়তারা শুরু করে দুর্নীতিবাজ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অত্র পরিদপ্তরের স্কুলটিতে যারা শিক্ষকতা করতো তারা সাধারণত শ্রমিক ক্যাটাগরীতেই নিয়োগ পেয়েছিলেন। স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়ার হীন চক্রান্তের অংশ হিসেবেই নিট বেইজড সেটআপে শিক্ষকদেরকে রাখা হয়নি। কারণ স্কুলটির পাশে ব্যাংক ভাড়া দিয়ে ড্রেজার কর্তৃপক্ষ মোটা অংকের ফায়দা লুটে। এই স্কুল ভবনটিও কোন বেসরকারী সংস্থার কাছে ভাড়া দেওয়ার পায়তারা করছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকদের মাত্র ১লাখ ৩০ হাজার টাকা বেতন দিতে হতো। অথচ এই ড্রেজার পরিদপ্তরের কোটি কোটি টাকার সম্পদ শীতলক্ষ্যা ডুবে আছে। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। দুই বছর আগে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীও এই ড্রেজার পরিদপ্তরে এসে নানা অনিয়মের বিষয় প্রত্যক্ষ করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শাসিয়েছিলেন। প্রকৌশলীরা চাকুরীতে নিয়োগের অল্প কিছুদিনের মধ্যে আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো বাড়ি গাড়ি ফ্ল্যাটের মালিক বনে যাচ্ছেন। অথচ শিক্ষকদের সামান্য বেতনের অজুহাত তুলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করার প্রচেষ্টা চলছে। আড়াই বছর আগে এমপি সেলিম ওসমান স্কুলটির দায়িত্ব নিতে চাইলেও নানা অজুহাতে স্কুলটির দায়িত্ব তাকে দেয়নি ড্রেজার কর্তৃপক্ষ। এখন তারা হাইকোর্টের নির্দেশও মানছেনা।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পারভীন আক্তার মালা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে আমরা স্কুলে আসার পরে দেখতে পাই প্রশিক্ষণার্থী আনসার সদস্যরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছেন। তবে স্কুলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। কারণ বার বার বন্ধের কারণে শিক্ষার্থী অনেক কমে গেছে। যারাও আসতে চায় কিন্তু তাদেরকে ড্রেজারের ফটকে থাকা আনসার সদস্যরা স্কুল বন্ধ হয়ে যাবেসহ নানা ধরনের কথা বলে। যে কারণে অনেক শিক্ষার্থীই অন্য স্কুলে চলে গেছে। এভাবে সব শিক্ষার্থী যদি চলে যায় তাহলে যারা স্কুলটি বন্ধের চক্রান্ত করছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। তাই স্কুলটি যথাযথভাবে চালুর বিষয়টি দ্রুত সুরহা না করা হলে একটা সময় হয়তো শিক্ষার্থীর অভাবে আমাদের শিক্ষকরা হতাশ হয়ে পড়বে। তাই এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতনদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।