ময়লায় কলংক, টিউমারে?
স্পেশাল করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ১১:৪৮ এএম, ৭ অক্টোবর ২০২১ বৃহস্পতিবার

নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সড়ক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড। সড়কের অধিকাংশ স্থানই পড়েছে জেলার ৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকায়। এই সড়ক প্রশস্থ করেছে বাণিজ্যের দুয়ার। চাষাঢ়া-আদমজী এবং ঢাকা নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক লিংক রোডের পূর্বে নির্মিত হলেও গুরুত্বের দিক থেকে জায়গা করে নিয়েছে লিংক রোড। ৪ লেনের এই সড়কে প্রতিদিন লাখো মানুষ যাতায়াত করে থাকে। তবে এর মাঝেও দুর্ভোগের শেষ নেই পরিবহণ চালক ও যাত্রীদের।
গত ১০ বছর ধরে প্রতিনিয়ন নাকে রুমাল চেপে চলাচল করতে হয়েছে যাত্রীদের। সড়কের উভয় পাশে গৃহস্থলির বর্জ্য ফেলে অস্থায়ী ডাম্পিং জোনে পরিণত করা হয়েছে সড়ক ও জনপথের জায়গা। তবে এই স্থানে ময়লা কারা ফেলে এনিয়ে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের দুইটি বলয় একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে। একদিকে মেয়র বলেন লিংক রোডের সকল বর্জ্য শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকা থেকে ফেলা হয়। অপরদিকে ওসমান পরিবার ও তাদের অনুসারীরা বলেন, নাসিক থেকেই ফেলা হয় এই বর্জ্য। যদিও নাসিক বর্তমানে সিটি করপোরেশনের আল আমিন নগর এলাকায় বর্জ্য ডাম্পিং করে থাকে।
নাসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মেয়র থেকে শুরু করে সকল কর্মকর্তার স্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। তবে সিটির বাইরে সদর উপজেলার বর্জ্য কোথায় ডাম্পিং হয় তা নিয়ে ওসমান পন্থিরা মুখ না খুললেও সকলেই অবগত আছেন যে এই বর্জ্য শেষতক সড়কের পাশেই ফেলা হতো। তবে বর্তমানে সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু হওয়ায় জায়গা পরিবর্তন করেছে বর্জ্য সংগ্রহ কারী এনজিও সমূহ।
শুধু গৃহস্থলির বর্জ্য নয়। এই সড়কের পাশে মৃত গরুও ফেলে রাখার দৃশ্য দেখা গেছে। এছাড়া প্রায় ৫ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে পলিথিন বর্জ্যে আগুণ লাগিয়ে দেয়ার বিষয়টি ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা। প্লাস্টিক ও পলিথিন পোড়ানো ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো মানুষের। চিকিৎসকদের মতে, এই ধোঁয়া দীর্ঘদিন মানুষের দেহে প্রবেশ করলে তা ক্যান্সারের মত রোগ তৈরী করে।
এতো গেলো বর্জ্য অব্যবস্থাপনার যত কথা। সড়ক সম্প্রসারণের জন্য সড়কের দুইপাশ খুঁড়তেই উঠে আসে বহু বছরের পুরোনো প্লাস্টিক বর্জ্য। সেসব ঢাকা দক্ষিন সিটি করপোরেশনের সাথে যোগাযোগ করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনের সাংসদ সেলিম ওসমান ৩০ সেপ্টেম্বর দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে আয়োজিত এক সভায় বলেন, ‘পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনের কলংক যদি দেখতে চান তাহলে লিংক রোড দিয়ে একটু ঢাকা যাইয়েন। দেখবেন যত মাটি গর্ত করে তত নিচ থেকে ময়লা উঠে। যত কলংক আছে মাটিতে চাপা দিয়ে দিসে’। ইঙ্গিতে তিনি পুরো অব্যবস্থাপনার দায় নাসিকের ঘাড়েই চাপিয়ে দেন। তবে মেয়র আইভী সিটি করপোরেশন বহু আগে থেকেই এই বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন।
বর্জ্য সমস্যার পাশাপাশি লিংক রোডের অন্যতম দুটি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে এই সড়কে চলাচলরত যাত্রীরা। সড়কে খানা খন্দকের অভিযোগ নিয়মিত থাকলেও গত ৩ বছর ধরে এই সড়কে নতুন আতঙ্ক হিসেবে হাজির হয়েছে টিউমার। সড়কের মাঝে পিচ ফুলে থাকে যার উচ্চতা স্পিড ব্রেকারের চাইতেও বেশী। এতে নেই কোন সতর্কতার চিহ্ন কিংবা সাদা রঙ। ফলে সড়কে স্বাভাবিক গতিতে চলাচল করা গাড়ীর চাকা টিউমারে ধাক্কা লেগে ঝাঁকুনি খায়। কখনও কখনও টিউমার এড়াতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় যানবাহন। কোন ইন্ডিকেটর ছাড়াই লেন পরিবর্তন করতে হয় চালকদের। আর এতে করেই দুর্ঘটনা ঘটে যায় অহরহ। সওজের পক্ষ থেকে একাধিকবার এই টিউমার অপসারণ করা হলেও তা ২ মাসের মাথায় পুনরায় পূর্বের রূপ ধারণ করে। রাতের আঁধারে এই সড়কে টিউমারের কারনে দুর্ঘটনা এখন নিত্যনৈমেত্তিক ঘটনা।
টিউমারের পাশাপাশি পুরো সড়কে নেই একটিও সড়কবাতি। ৪ লেনের সড়কে যানবাহনের হেডলাইটই একমাত্র আলোর উৎস। গুরুত্বপূর্ন মোড়ে দোকানের আলো দেখা মেলে। আর রাত গভীর হলে কমে আসে গাড়ির চাপ। পুরো অন্ধকার হয়ে থাকে সড়কটি। এতে করে চুরি ছিনতাই এবং গাড়ি চোরদের উৎপাত লেগে থাকে সারাবছরই। সাংসদ শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকায় এতবড় গুরুত্বপূর্ন সড়কে এমন ভোগান্তির চিত্র বছরের পর বছর চলে আসলেও তা দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন তারা।
তবে সড়ক সম্প্রসারন কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে। এই পরিকল্পনায় সড়ক হবে ৬ লেন। যুক্ত হবে সড়কবাতি, ড্রেন এবং ফুটপাত। প্রায় ২২ বছর ধরে দুর্ভোগের শিকার হওয়া যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা নতুন করে আশার আলো দেখছে। একই ভোগান্তি সংস্কারের পরেও পোহাতে চান না তারা।
রাজনৈতিক সংশ্লীষ্টরা বলছেন, সাংসদ সেলিম ওসমান যেভাবে বর্জ্যকেই কলংক অভিহিত করে গেলেন তাতে ভোগান্তির বিষয়টি উঠে এসেছে এক পাক্ষিক ভাবে। অথচ প্রভাবশালী সাংসদ চাইলেই এই সড়কের মান উন্নয়ন হতে পারতো বহু আগেই। প্রতিনিয়ন টিউমার যুক্ত সড়কে ভোগান্তি হতো না যাত্রীদের। রাতের আঁধারে ডুবে থাকতো না সড়ক। কলংক কেবল বর্জ্যে নয়, সড়কের ভোগান্তিও কলংকের তালিকায় উঠে এসেছে বহুবার।