সাংবাদিক ইলিয়াস পরিবারে দৈন্যদশা
স্টাফ করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ১০:৫০ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০২১ সোমবার

এক বছরেও শুরু হয়নি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সাংবাদিক ইলিয়াস হত্যাকান্ডের বিচার। গেল বছরের ১১ অক্টোবর রাতে বাসায় যাওয়ার পথে উপজেলার আদমপুর এলাকায় সাংবাদিক ইলিয়াসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলেও এক বছরের ব্যবধানেও শুরু হয়নি বিচার। কয়েক মাস পূর্বে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ৮ আসামীর মধ্যে ৬জনকে বাদ দিয়ে চার্জশীট দাখিল করলেও রহস্যজনক কারণে নারাজি দেননি মামলা বাদি নিহত ইলিয়াসের স্ত্রী। যে কারণে গুঞ্জন উঠেছে সাংবাদিক ইলিয়াসের স্ত্রী প্রতিপক্ষের দ্বারা ম্যানেজ হয়ে গেছেন। যদিও এ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সাংবাদিক ইলিয়াসের স্ত্রী।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর রাতে বাসায় যাওয়ার পথে উপজেলার আদমপুর এলাকায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা সাংবাদিক ইলিয়াসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরী বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। নিহত ইলিয়াস স্থানীয় দৈনিক বিজয় পত্রিকার বন্দর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতো। ওই রাতে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত তুষারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে সময় তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ধারালো ছুরিও উদ্ধার করা হয়। পরে ভোরে জিওধরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিন্নাত আলী ও মিসির আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত ইলিয়াসের স্ত্রী ৮ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা দায়ের করেন। এতে আসামি করা হয় গ্রেপ্তারকৃত তুষার (২৮), মিন্নাত আলী (৬০) ও মিসির আলীকে (৫৩)। আর পলাতক ছিলেন হাসনাত আহমেদ তুর্জয় (২৪), মাসুদ (৩৬), সাগর (২৬), পাভেল (২৫) ও হযরত আলী (৫০)।
২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর বিকেলে নারায়ণগঞ্জ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবীরের আদালতে গ্রেফতারকৃত তুষারে জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বন্দর থানার পরিদর্শক আজগর হোসেন বলেন, আদালতে তুষার সাংবাদিক ইলিয়াসকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছেন বলে জানিয়েছেন। আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তুষার জানিয়েছেন, পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে তিনি ইলিয়াসকে হত্যা করেন। একই এলাকায় পাশাপাশি বসবাস ছিল সাংবাদিক ইলিয়াস ও তুষারদের। ২০১৮ সালে মাদক বিক্রিতে বাধা দেওয়ায় শামীম নামে এক যুবকের সঙ্গে তুষারের ঝগড়া হয়। ওই সময় তুষার লাঠি দিয়ে শামীমের মাথায় আঘাত করলে গুরুতর আহত হন শামীম। এ ঘটনায় তুষারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন শামীম। আর সেই মামলা করতে সাংবাদিক ইলিয়াস উস্কানি দিয়েছিলেন বলে ধারণা তুষারের। এছাড়াও এলাকায় অবৈধ গ্যাস লাইনের সংযোগ দেওয়ার টাকা নিয়ে তুষার, ইলিয়াস, মাসুদসহ আরো কয়েকজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এসবের জের ধরেই সাংবাদিক ইলিয়াসকে হত্যা করা হয়।
এদিকে দীর্ঘদিনেও বন্দর থানা পুলিশ আসামীদের গ্রেফতারে ব্যর্থ হওয়ায় পরে মামলাটি ডিবি বা পিবিআইতে হস্তান্তরের দাবির মুখে জেলা গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) মামলাটি স্থানান্তর করা হয়।
২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর বন্দরে সাংবাদিক ইলিয়াস শেখ হত্যা মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেফতার এবং দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি স্থানান্তরের দাবিতে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। নগরীর চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংবাদিক জোটের ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হয়।
এদিকে আসামীপক্ষের লোকজন ইলিয়াসের পরিবার স্বজনদের উল্টো হুমকি দিয়ে আসছিল। এতে সাংবাদিক মহল তাদের পাশে দাড়ালেও কোন জনপ্রতিনিধি বা নেতারা পাশে দাড়ায়নি। এমনকি আর্থিক সহযোগিতায়ও দু-একজন ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেনি। আবার অনেকে বিগত সময়ে যোগাযোগ করলেও সময়ের ব্যবধানে ভুলে গেছে সবাই।
কয়েক মাস পূর্বে ৮ আসামীর মধ্যে ৬ আসামীকে বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তৎকালে মামলার বাদি নিহত ইলিয়াসের স্ত্রী জুলেখা বেগম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন তিনি আদালতে নারাজী দিবেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আর আদালতে নারাজী দাখিল করেননি বলে জানা গেছে। যে কারণে গুঞ্জন উঠেছে অব্যাহতি প্রাপ্ত আসামীদের সঙ্গে মামলার বাদিনীর সমঝোতা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নিহত ইলিয়াসের স্ত্রী জুলেখা বেগম বলেন, আমার স্বামী সাংবাদিক ইলিয়াস হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে পুরো পরিবার আজ পথে বসে গেছে। তিনি একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন। আমি নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। একারণে কোন কাজও করতে পারিনা। সংসারের কাজও করতে পারিনা। এই অবস্থায় একেবারে অসহায়ভাবে দিনাতিপাত করছি। এলাকাবাসী সহ আশেপাশের লোকজন বিভিন্নভাবে আর্থিক সহযোগিতা করেছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিলনা। আমি মানুষের কাছে হাত পেতে আদালতে দৌড়ঝাপ করেছি। কিন্তু তেমন কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় আমি সন্তানদের নিয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় বাবার বাড়িতে চলে আসছি। আসামী পক্ষের লোকজনের সাথে ক্ষমতাসীন দলের বড় বড় নেতাদের হাত আছে। তারা প্রশাসনসহ সব জায়গা ম্যানেজ করে নিয়েছিল। আমি প্রতিপক্ষের কারো সঙ্গে সমঝোতা করিনি। কিন্তু অর্থের অভাবে ও অসুস্থতার কারণে মামলা পরিচালনাও করতে পারছিলাম না। যে কারণে আমি আর নারাজী দেইনি। আমি আদালতকে বলেছি যারা প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল তাদের বিচার যেন অবশ্যই হয়।
তিনি বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন আদালতের বিচার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এখনো বিচার শুরু হয়নি বলে আইনজীবীর মাধ্যমে শুনেছি।