এত সাহস পায় কোথায়!

ছেলেকে সামলাতে পারেননি খোদ বাবা। কলেজের অধ্যক্ষও দুই দফায় দিয়েছেন সুযোগ। সেই সুযোগের অপব্যবহার করায় ফরম ফিলাপে আপত্তি জানিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কলেজ ছাত্র ডেকে এনেছে এলাকার বড় ভাই খ্যাত ছাত্রলীগ নেতাকে। তিনি এসে হুমকি ধামকি দিয়েও টলাতে পারেননি অধ্যক্ষকে। এবার সেই ছাত্র জেলা প্রশাসন বরাবর আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে পাঠিয়েছে চিঠি। এমন সাহস দেখে রীতিমত তাজ্জব হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সচেতন নাগরিকরা। ইন্টার পড়ুয়া ছেলের এত বড় সাহস কিভাবে আসলো তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির প্রভাবেই এমনটা হয়ে থাকতে পারে।
এদিকে শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন ও মানবিক দিক বিবেচনায় এইচএসসির ফরম ফিলাপ করতে দেওয়া হয়েছে গিয়াসউদ্দিন ইসলামিক মডেল কলেজের শিক্ষার্থী তানভীন ইসলামকে। সোমবার (৩০ আগস্ট) সকালের দিকে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে কলেজ অধ্যক্ষ মীর মোসাদ্দেক হোসাইন ওই ছাত্রকে ফরম ফিলাপ করার অনুমতি প্রদান করেন।
এর আগে শিক্ষার্থীর পিতা তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তার ছেলের হয়ে ক্ষমা প্রার্থনাসহ স্বহস্তে লিখিত অঙ্গিকারনামা দেন।
রোববার (২৯ আগস্ট) বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের গিয়াসউদ্দিন ইসলামিক মডেল কলেজের শিক্ষার্থী তানভীন ইসলাম জেলা প্রশাসকের নিকট এইচএসসি ফরম ফিলাপের জন্য আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে পত্র পেরন করেন। সেই পত্রে লেখা হয়, ‘আমি গিয়াসউদ্দিন ইসলামিক মডেল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। আমি করোনাকালীন সময়ে অসুস্থ থাকায় দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে ক্লাস করতে পারিনি। এজন্য আমি যাতে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারি সেজন্য অনুরোধ করতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রসহ কলেজে যান বাবা। তবে কলেজে তাকে অপমান করা হয়।’
ওই ছাত্র আরও উল্লেখ করেন, অনলাইন ক্লাস না করলেও আমি প্রতিটি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছি। কিন্তু আমার অনলাইন ক্লাসে অনুপস্থিতি এবং বাবার সঙ্গে তর্কের জেদ ধরে আমার পরীক্ষার ফরম পূরণ বাতিল করেন কলেজ অধ্যক্ষ। আমাকে কলেজে ডেকে নিয়ে জানানো হয়, আমি এ বছর আর পরীক্ষা দিতে পারবো না। এই বছর যদি আমাকে পরীক্ষার জন্য সুযোগ না দেওয়া হয় তাহলে আমার আত্মহত্যা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। এজন্য ফরম পূরণের সুযোগ দিয়ে আমাকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিন।
গত ২৫ আগস্ট গিয়াসউদ্দিন ইসলামিক মডেল কলেজের অধ্যক্ষ নিজে তানভীনের পিতা তাজুল ইসলামকে বিষয়টি অবগত করার পরে তানভীন মহানগর ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক দ্বীন ইসলামকে সাথে নিয়ে আসে। তানভীনকে কেন ফরম ফিলাপ করতে দেওয়া হবে না এনিয়ে কথার এক পর্যায়ে অধ্যক্ষের দিকে মারমুখি ভঙ্গিতে মারতে তেড়ে যান এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকেন। তখন অধ্যক্ষ তাকে হাত নেড়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। এসময় তিনি আবারও তেড়ে আসতে চাইলে উপস্থিত শিক্ষকেরা তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করলে তিনি অধ্যক্ষকে কলেজের বাইরে এলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেন।
এই ঘটনার পর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরী দায়ের করেন অধ্যক্ষ মোসাদ্দেক হোসেন। ঘটনার ২ দিন পর থানায় পাল্টা জিডি করেন ছাত্রলীগ নেতা দ্বীন ইসলাম। সেখানে তিনি উল্টো অধ্যক্ষ তাকে গুলি করার হুমকি দিয়েছেন এমন দাবী জানান। সবশেষ ২৯ আগস্ট পুরো ঘটনার মূল নায়ক তানভীন এবার নিজেই আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি প্রেরণ করেছে।
এদিকে তানভীনের এমন আচরণ দেখে হতবাক হয়েছেন শিক্ষক মহল থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের সচেতন মহল। কারন, প্রকাশ্যে আত্মহত্যার হুমকি দেয়া অপরাধের শামিল। দন্ডবিধির ৩০৯ ধারা অনুযায়ী আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর শাস্তি হচ্ছে এক বছর কারাদ-। এমন অপরাধের সাথে যুক্ত হবার বিষয়টি খোলা চিঠিতে লিখে জানানো হুমকি স্বরূপ এবং তা অন্যায়ের অংশ বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের অধ্যক্ষ বেলা রানী সিংহ বলেন, এই ছেলে মানসিকভাবে সুস্থ কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এটি কোন ছাত্র সুলভ আচরণ নয়। শিক্ষক তার মত করে চেষ্টা করেছে যে আমরা যদি পরীক্ষা না নিতে পারি তাহলে আমাদের এসাইনমেন্টটা গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। এর উপরেই মার্কস নির্ধারন করা হবে। ছেলেমেয়েরা যদি ঠিকমত ক্লাসে অংশ না নেয়, তার উপর এই ধরণের আচরণ করে তাহলে বোঝাই যাচ্ছে তার গার্ডিয়ান তাকে কন্ট্রোল করতে ব্যার্থ। এই ছেলেকে টিচার কিভাবে কন্ট্রোল করবে? সুতরাং বলাই যায় এই ছেলে অবশ্যই বিগড়ে গেছে। চারদিকে যেভাবে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি তৈরী হচ্ছে তার কিছুটা প্রভাব এতে পরতে পারে বলে মনে হচ্ছে। এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। তা না হলে এই ধরণের অন্যায় হুমকি কেউ দিতে পারে না। ছাত্রদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে, শিক্ষকরা তার ভালোর জন্যেই চেষ্টা করে।
নারায়ণগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল হক রুমন রেজা বলেন, এই ছেলেকে তার অভিভাবকের উচিত বাড়ি নিয়ে মোটিভেশন করা। করোনাকালে সব প্রতিষ্ঠান ছাড় দিচ্ছে। কিন্তু সে কোন ক্লাসে অংশ না নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিবে এটা মেনে নেয়া সম্ভব না। শিক্ষক তার জায়গা থেকে ঠিক রয়েছে। সরকার এসাইনমেন্ট চালু করেছে পাঠের সাথে সংযোগ তৈরীর জন্য। কিন্তু ছাত্র যদি ক্লাসেই না আসে তাহলে সে এসাইনমেন্ট করবে কিভাবে? ক্লাসে যুক্ত না থেকে এই ধরণের আবদার করা অযৌক্তিক। এই ধরণের হুমকি সে কিভাবে দিলো সেটা খতিয়ে দেখা উচিৎ। এইধরনের প্রবণতা কোন শিক্ষার্থীর ভেতরে যাতে না জন্মায় সেদিকে অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখতে হবে। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের ছেলেদের বের করে আনা দরকার। এই ধরণের চিঠি প্রেরণ করা অত্যান্ত দুঃখজনক। শিক্ষকের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে হুমকি ধামকি দেয়া ছাত্রদের থেকে কোনভাবেই কাম্য না।
এদিকে ২৯ আগস্ট রোববার দুপুরের দিকেই কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী তানভীনের শিক্ষা জীবনের কথা বিবেচনা করে তার ফরম ফিলাপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে এদিন দুপুরের পরই ওই শিক্ষার্থী জেলা প্রশাসনের কাছে মিথ্যার আশ্রায় নিয়ে একটি লিখিত আবেদন করেন। যেখানে সে ফরম ফিলাপ করতে না দিলে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তের কথাও জানান।
শিক্ষার্থীর পিতা তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত দেওয়ার বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। এবং এসএসসিতে সে জিপিএ-৫ পায়নি। এ পেয়েছিল। তবে এর আগে সে ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত ভালো ছিলো। সঙ্গদোষে অমনোযোগী হয়ে উঠে। প্রথমে তার জন্য গেল বছরের অক্টোবরে কলেজে অঙ্গিবারনামা দেন তিনি। এরপর কদিন ঠিকঠাক থাকলেও আবারও অনিয়মিত ক্লাস (অনলাইন) করে। এ কারণে গেল কোরবানি ঈদের পূর্বে ছেলের জন্য কলেজে ক্ষমা চেয়ে অঙ্গিকারনামা দিয়েছিলেন তিনি। এরপরও তার ছেলে নিয়মিক ক্লাস এবং অ্যাসাইনমেন্ট করতেন না। পরবর্তীতে ওই শিক্ষার্থী ফরম ফিলাপ করতে চাইলে এতে বাধ সাধেন কলেজ অধ্যক্ষ। এবং বিষয়টি তার পিতাকে জানালে তিনি লজ্জিত এবং ছেলের জন্য অনুরোধ করার মতো মুখ আর তার নেই বলে জানান অধ্যক্ষকে।
জেলা প্রশাসকের বরাবর লিখিত দেওয়া প্রসঙ্গে তানভিন জানিয়েছে, সে এসব লিখতে চায়নি। কম্পিউটারের দোকান থেকে এগুলো লিখে দিয়েছে। এটি করা তার ঠিক হয়নি। ভুল হয়েছে বলেও সে জানায়। একই সাথে সে অনিয়মিত ক্লাস, অমনোযোগী হওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করে। পাশাপাশি এমন ভুল আর কখনও সে করবে না বলেও জানিয়েছে।
এদিকে এসএসসিতে ওই শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিল বলে কিছু কিছু স্থানে প্রচার করা হলেও বিষয়টি সত্য নয় বলে ওই শিক্ষার্থী নিজেই স্বীকার করেন সাংবাদিকদের সামনে। তার বাবা জানিয়েছে, তার ছেলে ব্রিলিয়েন্ট ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে সে অমনোযোগী হয়ে যায়। যার কারণে এসএসসিতে এ পেয়েছিল। এবং কলেজে উঠে সে নিয়মিত ক্লাস করতো না। তাকে একটি স্কুটি কিনে দেওয়া হয়েছিলো। সেটি নিয়ে এবং কিছু বাজে মানুষের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সে অমনোযোগী হয়ে পড়ে।
অধ্যক্ষ মীর মোসাদ্দেক হোসাইন বলেন, আমরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাকে (তানভীন) ফরম ফিলাপ করতে দিবো। শিক্ষক হিসেবে তাকে কিছুটা চাপ প্রয়োগ করার দরকার ছিলো বলে আমরা তা করেছি। কারণ সে আগে ভালো ছাত্র থাকলেও পরবর্তীতে সে একেবারেই অমনোযোগী হয়ে উঠে। একজন শিক্ষক হিসেবে অমনোযোগী ছাত্রকে শাসন না করে আস্কারা দিতে পারি না। তাই ক্লাস না করেও ফরম ফিলাপ করতে আসায় তা দিতে চাইনি। চেয়েছিলাম তার অভিভাবক আসুক, বিষয়টি জানুক। কেননা এই ছাত্র যদি পরীক্ষায় বসে অকৃতকার্য হয় তাহলে তার অভিভাব দায়ভারটা আমাদের ঘাড়েই ফেলবেন। এছাড়া আমাদের কলেজেরও সুনাম নষ্ট হবে। কেননা, জেলার মধ্যে প্রতিবারই শতভাগ পাসের রেকর্ড আমাদের। তবে ঘটনার পরপর তার অভিভাবক এলে বিষয়টা এতদূর যেত না। তৃতীয় পক্ষ এসেই বিষয়টি জটিল করে তুলেছে।