নারায়ণগঞ্জে খুলবে ৮৪৭ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

ডেটলাইন ১২ সেপ্টেম্বর। এদিন থেকেই খুলবে নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকসহ ৮৪৭ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আবেগ, আনন্দ ও শংকা-এ তিনের সমন্বয়ে তৈরী অদৃশ্য বন্দীত্বের জাল ছিন্ন করে ছোট ছোট শিশুরা ছুটবে স্কুলের দিকে। অনেক স্কুল ঝকঝকে পরিস্কার, অনেকগুলোতে অবহেলার ছাপ। তবুও ভাঙ্গবে অচলায়তন। শিশু-কিশোরদের কলকাকলিতে মুখরিত হবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গন। প্রথম কয়েক দিন অভিভাবকেরা সাথে যাবেন। তবুও দেড়বছরের অঘোষিত ছুটির প্রহর কাটুক। এমন প্রত্যাশা অভিভাবক, শিক্ষক ও সুধীমহলের।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সকল প্রস্তুতী শেষের দিকে। স্কুলে যেতে মুখিয়ে আছে প্রাথমিক স্তরের ৩ লাখ ৯৬ হাজার শিক্ষার্থী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ১ লাখ ৪০ হাজার ও মাদ্রাসার ২৫ হাজার শিক্ষার্থী। প্রাথমিকের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে শতকরা ৯২ ভাগের টিকা নেয়া সম্পন্ন হয়েছে। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ও পরিক্ষার্থী মিলিয়ে ২ লাখ ২৪ হাজার ৮৭৫ জনের তালিকা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই এ টিকার কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের টিকা বেশির ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
তবুও শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের শংকা যেন কাটতে চায় না। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ সার্বিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে জেলার সর্বস্তরের শিক্ষা অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করলেন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের আলোকে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ প্রস্তুতী সম্পর্কে খোঁজ নিতে নির্দেশ দিলেন শিক্ষা অফিসারদের। প্রাথমিকের ৩১ জন এবং মাধ্যমিকের ২২ জন শিক্ষা অফিসার বৈঠকে অংশ নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন এবং জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা গ্রহণ করেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশ অনুসারে আগামী দু’দিনের (১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর) মধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল প্রস্তুতী সম্পন্ন করতে হবে। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর ) জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সকল শিক্ষা অফিসারদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আলোচ্য বিষয় ছিল; ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে। তাই পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সকল প্রস্তুতী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ছাত্রীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যতটুকু সম্ভব হ্যান্ড স্যানিটাইজার সামগ্রী রাখতে হবে। সবার মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। স্কুলে এক বেঞ্চে বসবে দুই জন। ফলে ক্লাস রুম বাড়বে। ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস হবে।
শহরের ভূঁইয়া পাড়ার একটি প্রাইমারী স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সানজিদাসাহা’র অপেক্ষার প্রহর কাটছেই না। ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে টেলিভিশনে স্কুল খুলে দেওয়ার খবর শোনে। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে অন্য বন্ধুদের খবরটি জানায়। এরপর থেকে স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, জুতোসহ অন্যান্য সামগ্রীর খোঁজ খবর শুরু করে। এছাড়া ক্লাসে যেতে আর কী লাগবে সেই তালিকা করছে। ইতোমধ্যে তার জুতো ও স্কুল ড্রেস ছোট হয়ে গেছে। তাই এগুলো কিনে দিতেমা-বাবাকে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। দিনেএকাধিকবার গুনছে আর কতদিন বাকি ১২ সেপ্টেম্বরের। প্রায় দেড় বছর পর সে স্কুলেযাবে। সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে দেখাহবে। তার আনন্দের যেনসীমা নেই।
স্কুলে আবার যাবে, মাঠে খেলবে, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবে-এই ভাবনায় আপ্লুত তারা। নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত ৬ লাখ শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই সরাসরি পাঠদানের প্রহর গুনছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই ঘর বন্দি। শহরাঞ্চলের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরাও বাসার বাইরে যাওয়ার তেমন একটি সুযোগপায়নি। বর্তমানে জেলায় প্রাথমিক স্তরে ৪ লাখ আর মাধ্যমিক স্তরে দেড়লাখ শিক্ষার্থী আছে। এর বাইরে আছে মাদ্রাসা স্তরে প্রায় ২৫ হাজারশিক্ষার্থী।
নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলের একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, ‘আসলে আমরা শিক্ষকরাও ছাত্রছাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছি। কতদিন ওদের সংস্পর্শ পাচ্ছিনা! তবে এই ক্লাস চালুকে সামনে রেখে বিশাল দায়িত্ব চলে এসেছে আমাদের ওপর। মহামারিকালে সবাইকে স্বাস্থ্যগতভাবে সুরক্ষিত রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা স্কুল প্রস্তুত করছি। সরকার ইতোমধ্যে ৩৮ পৃষ্ঠার সুলিখিত গাইডলাইন পাঠিয়েছে। সেখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কথাও আছে। তাদের সচেতন করতে আমরা ৯ সেপ্টেম্বর অভিভাবকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করব। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ভাগ করে শ্রেণি ও শিফট অনুযায়ী আলাদা সময়ে আনার জন্য রুটিন করছি। ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও সমন্বয় করতে হবে। সবমিলে আসলে এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।’
জেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ও মাদ্রাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩৮ পৃষ্ঠার গাইডলাইন এবং সর্বশেষ রোববার পাঠানো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরেও (মাউশি) ১৯ দফা নির্দেশিকার আলোকে পাঠদান উপযোগী করার কাজ চলছে। তবে নাম প্রকাশ না করে অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষাপ্রশাসন তদারকি না করলে এই পরিচ্ছন্ন কাজ প্রত্যাশিত পর্যায়ে হবেনা। ওই অভিভাবক মাসদাইরের একটি স্কুলের নাম উল্লেখ করে বলেন, কয়েকদিন আগে তিনি তার এসএসসি পড়ুয়া ছেলের সঙ্গে স্কুলে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে যান। তখন দেখা গেছে, ক্লাসরুমে বেঞ্চিগুলোতে ধুলোর পাহাড় জমেছে। ওয়াশ রুমে গিয়ে তার সন্তানের বমি করার দশা হয়েছে।
১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষক এবং কর্মকর্তাকে টিকা দেওয়া ও আরেক চ্যালেঞ্জ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক-শিক্ষিকা আছে ৪ হাজার। তাদের মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশ রোববার পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন। স্কুল খোলার আগে অবশিষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী টিকা পাবেন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম ১৮ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই এমন শিক্ষার্থী প্রায় ৩০ লাখ হওয়ার কথা। তবে ইউজিসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কিছু কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক লাখ বয়স্ক শিক্ষার্থী আছে, যারা নিয়মিত শিক্ষার্থীর মধ্যে পড়েননা, তারাও সাড়ে ৪৪ লাখ শিক্ষার্থীর হিসাবের মধ্যে আছেন। ওসব শিক্ষার্থীর এনআইডি আছে এবং টিকাও নিয়েছেন। সেই হিসাবে এনআইডিবিহীন শিক্ষার্থী বেশি নয়। এরপর এনআইডি যাদের নেই তারা দুটি সুবিধা পাবেন। প্রথমত, নিকটস্থ নির্বাচন অফিসে গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের এনআইডি করে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনে যোগাযোগ করেছে। এছাড়া এ ধরনের শিক্ষার্থীরা জন্মনিবন্ধন কার্ড দিয়েও টিকা নিতে পারবেন।