করোনার দ্বিতীয় দফার ধাক্কায় তৈরি পোশাক খাত আবার অনিশ্চয়তায়

বিকেএমইএ এর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘গ্রীষ্মের নতুন আদেশ নিয়ে আমরা নতুন বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় ছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় দফার ধাক্কা আবার শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। এর বাইরে আরেকটি বড় শঙ্কার কারণ হচ্ছে সুতার বিশ্ববাজারে মাফিয়াচক্রের দৌরাত্ম্য।’
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভবে দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক আবার অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি বলেন, করোনার প্রথম দফার ধাক্কা সামলে পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার পর ক্রেতারা আদেশ দিতে শুরু করে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে ওই সব আদেশ স্থগিত করা হয়। ফলে স্থানীয় পোশাক মালিকদের মধ্যে আবার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রপ্তানি আয় বাড়াতে তিনি পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেন। করোনার কারণে খুব বেশি শ্রমিক চাকরি হারায়নি বলে দাবি করেন এমবি নিট ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম।
পোশাক শিল্পের বর্তমান অবস্থা, প্রণোদনা প্যাকেজ, পণ্যের বহুমুখীকরণসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু কাওসার ও শাহ আলম খান।
প্রশ্ন: করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাতে নতুন করে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে কি না?
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আবারও লকডাউনে চলে গেছে। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৭০ শতাংশ যায় এ বাজারে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা আমাদের পোশাকের চেইন স্টোরগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রথম দফা ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর পর নতুন করে ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ দেয়ার যে প্রবণতা শুরু করেছিল, দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে সেটাও আবার স্থগিত হয়ে গেছে।
গ্রীষ্মের নতুন আদেশ নিয়ে আমরা নতুন বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারীর দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় ছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় দফার ধাক্কা আবার শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। এর বাইরে আরেকটি বড় শঙ্কার কারণ হচ্ছে সুতার বিশ্ববাজারে মাফিয়াচক্রের দৌরাত্ম্য। এই চক্রটি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ফলে মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে সুতার দাম। আগে যে আদেশগুলো পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো সময়মতো শিপমেন্ট করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ প্রতি কেজি ২ ডলার ৯০ সেন্টে যে সুতার দাম ঠিক করা হয়, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০-৫০ সেন্টে। এ পরিস্থিতিতে আমরা শঙ্কিত চুক্তির বাইরে বাড়তি খরচ কিভাবে পোষাব।
প্রথম যখন করোনা শুরু হয়েছিল, তখনও শঙ্কা ছিল। যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পর এপ্রিলে কারখানাগুলো খুলে দেয়া হলো। এর সুফল আসে রফতানি খাতে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় টেউয়ের কারণে আবার ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছি আমরা।
প্রশ্ন: কত সময় পর্যন্ত করোনা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে?
এটা বলা অসম্ভব। কোনোভাবোই অনুমান করতে পারছি না আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যে শেষ হবে। তাই কোনো ভবিষ্যত বাণী করতে পারছি না।
প্রথম ভেবেছিলাম, জানুয়ারি থেকে হয়তো ভাল অবস্থানে যেতে পারব। সেই আশা তিরোহিত হয়ে গেছে। কার্যকর ভ্যাকসিন আসছে। কিন্তু এর সুফল মানুষ কত দ্রুত পাবে, বিশ্ব পোশাকের বাজার কবে স্বাভাবিক হবে, ইউরোপ ও আমেরিকায় চলমান লকডাউন প্রত্যাহার হবে কি না, এসবের সুনির্দিষ্ট উত্তর কারো কাছে নেই। ফলে একটা অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে এবং সেটা আগামী ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত স্থায়ী থাকতে পারে।
প্রশ্ন: অভিযোগ উঠেছে, আগের দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজের বেশিরভাগ সুবিধাই পেয়েছেন পোশাক মালিকেরা। এ প্রেক্ষাপটে নতুন প্রণোদনা দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত বলে আপনি মনে করেন?
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেটা ছিল খুবই সময়োপযোগী। সেটি কিন্তু আমাদের চাইতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী দেশের ১৭ কোটি মানুষের অভিভাবক, ব্যবসায়ীদের অভিভাবক। পোশাক খাতেরও একজন অভিভাবক তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন, করোনা মোকাবিলায় প্রণোদনা প্রয়োজন। আর প্রয়োজন ছিল বলেই তিনি আমাদের চাওয়ার আগেই ঘোষণা দেন। এর সুফল দেশের মানুষ এবং রপ্তানি খাত ভালোভাবেই পাচ্ছে।
দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আবারও প্রণোদনা প্রয়োজন কি না সেটা প্রধানমন্ত্রীই ভাল জানেন। করোনার প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউ আরও কঠিনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রণোদনা আরও প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা ভাবতে হবে সরকারকেই।
বেশির ভাগ সুবিধা পোশাকখাত পেয়েছে এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ যে খাতটির অবদান, ৪৪ লাখ শ্রমিক যেখাতে কাজ করছে, সেখানে সুবিধা বেশি যাবেই। এটা দোষের কিছু নেই।
তারপরও বলছি, পোশাক খাতের সব উদ্যোক্তা প্রণোদনার ঋণ সুবিধা পায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক যে নিয়মনীতি বেঁধে দিয়েছে, তাতে অনেকের পক্ষে ঋণ নেয়া সম্ভব হয়নি।
বিকেএমইএ এর সাড়ে ৮শ সদস্যের মধ্যে ৫১৯ সদস্য ঋণ পেতে আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ৪২০টি প্রতিষ্ঠান সুবিধা পেয়েছে। বাকিরা পায়নি।
প্রশ্ন: দেশের রপ্তানিখাত এখনও তৈরি পোশাকসহ গুটিকয়েক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। সরকার দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করেও পণ্যের বৈচিত্র আনতে পারেনি। এই ব্যর্থতার কারণ কী - সরকারের নীতি সহায়তার অভাব নাকি বেসরকারি খাতের অদক্ষতা?
এটা ঠিক, একটি খাতের ওপর নির্ভরতা থাকলে যেকোনো সময় প্রতিকূল বা ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে পড়তে হতে পারে। ফলে পুরো রপ্তানিখাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। তাই রপ্তানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণ জরুরী।
সরকার রপ্তানি বহুমুখীকরণে বিভিন্ন নীতি-সহায়তা দিয়ে আসছে। বেসরকারি পর্যায়ে পোশাক রপ্তানিকারকরাও পণ্যের বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে।
এরপরও প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। কারণ খাতভিত্তিক অবস্থানের অসমতা। পোশাকখাতের রপ্তানি বছরে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের। অথচ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মাত্র মাত্র ১ বিলিয়নের। বিশাল অসমতার কারণে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।
প্রশ্ন: করোনায় পোশাকখাতে কী পরিমাণ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে? এদের সবাই কি চাকরি ফিরে পেয়েছে?
খুব বেশি চাকুরিচ্যুত হয়নি। করোনার কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছে, ওইসব প্রতিষ্ঠানের কিছু সংখ্যক শ্রমিক কাজ হারিয়েছে। তবে তারা আবার চাকরি পাওয়ায় কেউ এখন বেকার নেই। এক জায়গায় চাকরি হারালে আরেক জায়গায় কাজ পেয়েছে। কেউ আবার এলাকায় গিয়ে ভিন্ন খাতে কাজ নিয়েছে। বেশির ভাগ কারখানার গেটে এখনও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সাঁটানো আছে। তার মানে হচ্ছে শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে এবং তার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।
শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেন, লাখ লাখ শ্রমিক চাকুরিচ্যুত হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, কত শ্রমিক বেকার হয়েছে তালিকা দেন। তারা এখনও তালিকা দিতে পারেনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জার্মান সরকার পোশাকখাতে চাকরিচ্যুতদের জন্য একটা তহবিল গঠন করে। এ তহবিল থেকে ১০ লাখ শ্রমিককে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত আর্থিক সুবিধা দেয়া হবে।
বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ এর বাইরে আরও দুটি খাতের শ্রমিকদের ওই তহবিল থেকে সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তালিকার অভাবে তহবিলের অর্থ ছাড় হচ্ছে না। তাই প্রচুর শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রশ্ন: ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের করণীয় কী?
সরকার এ বিষয়ে নীতিগত সব ধরনের সহায়তা দিতে আন্তরিক। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, উদ্যোগগুলো যারা বাস্তবায়ন করবে, তাদের মধ্যে অদক্ষতা, দূরদর্শিতার অভাব, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। এসব বাধা দূর হলে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।