বিদ্রোহের ৩ বছরে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি


স্পেশাল করেসপনডেন্ট | প্রকাশিত: ১১:৪১ পিএম, ০৩ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার
বিদ্রোহের ৩ বছরে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি

নিরাপদ সড়কের দাবীতে ছাত্র আন্দোলন তথা কিশোর বিদ্রোহের ৩ বছরেও আন্দোলনকারীদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় এখনও ঝরছে প্রাণ। রাস্তায় ফিটনেস বিহীন যানবাহনের অবাধ ছড়াছড়ি। মহাসড়কে চলছে নিষিদ্ধ থ্রি হুইলার। লাইসেন্স এবং রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই যানবাহন চলছে অবাধে। আন্দোলনের দাবী অনুযায়ী পূরণের খাতা শূন্য হলেও এর মাঝেই আগামীর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন আন্দোলনকারীরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপদ সড়কের দাবীতে এই আন্দোলন করে রাষ্ট্রের চোখে আঙুল দিয়ে ত্রুটি ধরিয়ে দিয়েছে কিশোররা তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কার্যত সেই আন্দোলনের দাবীগুলো পূরণ হয়নি তা একেবারেই স্পষ্ট। কিশোররা যা চেয়েছিলো তার বাস্তবায়ন এখনও অনেক দূরে। কিন্তু এই কিশোরদের হাতেই যে আগামীর বাংলাদেশ তা নিয়ে সকলেই আশাবাদী। কারন মানুষ পরিবর্তন চায়, আর এই কিশোররাই আগামীতে পরিবর্তনের হাল ধরবে।

বর্তমানে আঞ্চলিক সড়ক থেকে মহাসড়কে সর্বত্র অনিয়ম বিদ্যমান। অপ্রাপ্ত বয়স্কের হাতে লেগুনা, লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই রাস্তায় নেমে যাচ্ছেন চালক, সিগন্যাল অমান্যের প্রতিযোগীতা, উল্টো পথে গাড়ি চলাচল সহ নানা অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। যার কারনে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। আন্দোলন চলাকালে সরকার দলীয় নেতা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা যে আশ্বাস দিয়েছিল তা আদৌ পূরণ হয়নি। ফলে অনেকের মাঝেই জন্মেছে হতাশা।

তবে এতসব হতাশার মাঝেও ভিন্ন কথা বলছেন তৎকালীন আন্দোলনকারী ও বর্তমানে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তাদের মতে এই আন্দোলন ভবিষ্যতে যেকোন আন্দোলন ও দাবীকে আরও বেগবান ও একত্রিত হতে সাহস জোগাবে।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক ফারহানা মানিক মুনা বলেন, ২০১৮ সালে আমরা যেই আন্দোলন করেছিলাম সেটিকে কিশোর বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা হয়। সেই আন্দোলন এই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। যখন মানুষ হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো তখন এই আন্দোলন মানুষের মাঝে আশার সঞ্চয় জন্ম দিয়েছে। সবাই যখন ভাবছিলো এই দেশে কিছু সম্ভব না তখন কিশোররা দেখিয়ে দিয়েছে তাদের দ্বারাই সব সম্ভব। এই তরুণদের উপরেই ভরসা করতে হবে। মুভমেন্টের দাবীগুলো পূরণ না হলেও সেই আকাঙ্খা এখনও বিদ্যমান। ছাত্ররা যখন বলছিলো রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে সেই ঘোষণা এই ৩ বছরে এসে অনেক বেশী যৌক্তিক এবং যথার্থ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নারায়ণগঞ্জ জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইবনে সানী বলেন, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পরে এবং ১ আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জেও আন্দোলন শুরু হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেসময় আন্দোলনের পাশাপাশি সড়ক নিরাপদ করতে যেই দায়িত্ব পালন করেছিলো তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

সেই আন্দোলন যেই আশ্বাসে সমাপ্ত হয়েছিলো সেই ৯ দাবীর একটিও ৩ বছরে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ৩ বছরে এসে বলতে চাই, নিরাপদ সড়ক আইন ২০১৮ সঠিক ভাবে বাস্তবায়নে সরকার সজাগ দৃষ্টি রাখবে,আইন সঠিক ভাবে সংশোধন করে তার প্রয়োগ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সড়কের নিরাপত্তা বাড়ানোর জোর দাবি করছি।

বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষন পরিষদের জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবিকুন নাহার কেয়া বলেন, ২০১৮ সালের আন্দোলনে শিক্ষার্থী হিসেবে আমি নিজেও তাতে অংশ নিয়েছিলাম। এই আন্দোলন রাষ্ট্রের চোখে আঙুল দিয়ে তার অনিয়ম দেখিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর জরুরী লেন তৈরী করতে না পারলেও ছাত্ররা তা দেখিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সড়কের আইনকে অমান্য করেছে, কিন্তু ছাত্রদের সামনে তা পারেনি। আন্দোলন থামাতে আশ্বাস এবং সড়ক আইন প্রনয়ন করলেও তা কেবল কাগজে-কলমে ই আছে বাস্তবে এর প্রয়োগ খুবই সামান্য। এখনও সড়কে ফিটনেস বিহীন গাড়ি, লাইসেন্স বিহীন বা অদক্ষ চালক, মাঝপথে যাত্রী উঠানো নামানো, উল্টোপথে গাড়ি চালানো, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলা সহ আগে যাওয়ার প্রবণতা অর্থা ওভারটেকিং এর মতো অপরাধ গুলাও অহরহ চলছে।

এই আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে নৈতিকতার সাথে থেকে কিভাবে রাষ্ট্রের উন্নতি বা রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়। আর পরিবহনের মতো একটা খাত যেখানে একটু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দুর্ঘটনায় মানুষের জীবন পর্যন্ত চলে যেতে পারে। সেখানে অর্থের লেনদেন করে অনিয়মকে নিয়মের ভেতর আনা ভয়াবহ অপরাধ। এই অনিয়মের কারনে কোনো মায়ের বুক খালি হতে পারে,সন্তানেরা পিতৃহারা হতে পারে। আর আমরা চাই না আমাদের মাঝ থেকে আবার কোনো রাজীব/দিয়া প্রাণ হারাক।

প্রসঙ্গত, ছাত্র আন্দোলনে ২০১৮ সালের ১ ও ২ আগস্ট টানা দুইদিন নারায়ণগঞ্জ শহরকে কার্যত অচল করে রাখে শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন বৃষ্টি উপেক্ষা কারেই রাজপথ দখলে নিয়েছিলেন তারা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর স্মরণকালের সর্ববৃহৎ আন্দোলন হিসেবে আবির্ভুত হয় এই আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা শহরের চাষাঢ়ায় অবস্থান নিয়ে রাজধানীর সঙ্গে সকল প্রকার যান চলাচল বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে অবস্থান করে শিক্ষার্থীরা ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে।

আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যানবাহন ও গাড়ির লাইসেন্স চেকিং করে। এই চেকিং থেকে পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ সহ কেউ বাদ পড়েনি। গোল চত্বরে অবস্থানকারী আন্দোলনকারীরা তাদের ৯ দফা দাবি সহ পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। এছাড়া সরকার দলীয় বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীদের কঠোর সমালোচনা করে। এর মধ্যে সড়কের শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সড়কের অবরোধ তুলে শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যান চলাচলে বাধ্য করে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা ট্রাফিকের ভূমিকায় সড়কের প্রত্যেকটি পয়েন্টে পয়েন্টে টহল দিয়েছে। কোন অবৈধ গাড়ি ও অবৈধ চালককে পেলেই গাড়ির চাবি জব্ধ করে রাখা হয়।

বিভিন্ন আশ্বাসে আন্দোলন শেষ হলেও সড়কের নৈরাজ্য সেই আগের অবস্থানে চলে যায়। সড়কের বিশৃঙ্খলতা থেকে যায় আগের মতই। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ছাত্র আন্দোলনের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। নিরাপদ সড়কের সেই দাবি কবে পূরন হবে তা আজও অজানাই রয়ে গেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুন:
newsnarayanganj-video
আজকের সবখবর