চোখের জল শীতলক্ষ্যায়
মোবাশ্বির শ্রাবন ও সোহেল রানা || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ১১:৩৮ পিএম, ৫ এপ্রিল ২০২১ সোমবার

সোমবার থেকে করোনার কারণে অঘোষিত লকডাউন শুরু। তাই কিছুটা প্রস্তুতি নিয়েই নাড়ির টানে নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেন অর্ধশত মানুষ। তাদের মধ্যে ছিল নারী, পুরুষ, শিশুরাও। চড়েন ‘সাবিত আল হাসান’ লঞ্চে। অনেকেই লঞ্চে সিট পেয়ে আবার অধিক চাপে সিট না পেলেও ছিলেন দুই পাশে কিংবা পেছনে নাজাজের স্থানের আশেপাশেই। কেউ বা ফোনে জানিয়ে দেন ‘আসছি আমি, লঞ্চ ছেড়েছে।’ বিপরীত প্রান্তের পরিবারের লোকজনও আশায় বসেছিল ঘরে ফিরছে তাদের প্রিয়জন। রোববার গোধূলী লগ্নে যখন লঞ্চটি শীতলক্ষ্যার বক্ষ দিয়ে আপন গতিতে চলছিল তখনো কেউ ঘুনাক্ষরে টের পায়নি পেছনেই ধেঁয়ে আসছে জমদূত। নির্মাণাধীন শীতলক্ষ্যা সেতুর পিলার দেখতে অনেকেই তখন লঞ্চ থেকে উকিঝুকি দেয়। ওই সময়ে মাত্র চোখের পলকে পেছন থেকে একটি কার্গো জাহাজ এসে স্বজোরে ধাক্কা দেয় লঞ্চটিকে। কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে তলিয়ে যায় লঞ্চটি। আশেপাশের লোকজন যারা দেখছিল তারা যখন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকলেও নীরব দর্শক ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তাদের। লঞ্চটিকে পানিতে তলিয়ে তার উপর দিয়েই বীরদর্পে চলে ঘাতক এসকেএল-৩ নামের কোস্টার ট্যাংকার জাহাজটি। লঞ্চ থেকে লাফিয়ে অনেকেই যখন তীরে তখনো নিখোঁজদের সন্ধানে শীতলক্ষ্যার তীরে শত শত মানুষের আহাজারি। রোববার লঞ্চ ডুবার পর প্রচন্ড গতিবেগে ঝড়, বৃষ্টি আর কালবৈশাখীর সময়েও নদীর তীঁরেই স্বজনদের ছুটেচলা। রাতের মধ্যে ৫জনের মরদেহ উদ্ধার করলেও তখনো নিখোঁজদের সন্ধানে প্রিয়জনদের আঁধার রাতেই এদিত ওদিক ছুটে চলা। সঙ্গে উদ্ধারকারী বিভিন্ন সংস্থারও প্রাণান্তর চেষ্টা। রাত পেরিয়ে যখন সকাল তখনো কারো কান্না থামেনি। লাশের জন্য অস্থির সকলে। বেলা গড়িয়ে দুপুরে ভরদুপুরে লঞ্চটি উদ্ধার করা হয় তখন যেন একেকজনের চোখের নোনা জলে ভেসে যায় শরীর। পড়তে থাকে দূষণে জর্জরিত শীতলক্ষ্যার কালো পানিতে। নোনা জ্বলে ভিজে শীতলক্ষ্যাও। লঞ্চ থেকে যখন একের পর এক লাশ উদ্ধার তখন কান্নায় স্তব্ধ সকলে। মায়ের কোলে সন্তানের লাশের সেই দৃশ্যে কেউ চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনি।
মৃতদের পরিচয়
সেই ভয়াবহ লঞ্চ ডুবির ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের সকলেই মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা।
সোমবার উদ্ধারকৃত মৃতরা হলেন, ‘রুনা আক্তার (২৪), সোলেমান ব্যাপারী (৬০), বেবী বেগম (৬০), সুনিতা সাহা (৪০), পখিনা বেগম (৪৫), বিথী (১৮), অরিফ (১), প্রতিমা শর্মা (৫৩), শামসুদ্দিন (৯০), রেহেনা বেগম (৬৫), হাফিজুর রহমান (২৪), তহমিনা (২০), আব্দুল্লাহ (১), নারায়ণ দাস (৬৫), পার্বতী রানী দাস (৪৫), আজমীর (২), শাহআলম মৃধা (৫৫), মহারাণী (৩৭), আনোয়ার হোসেন (৫৫), মাকসুদা বেগম (৩০), সাউদা আক্তার লতা (১৮), আব্দুল খালেক (৭০), জিবু (১৩), খাদিজা বেগম (৫০), মোহাম্মদ নয়ন (২৯), সাদিয়া আক্তার (৭), বিকাশ সাহা (২২) ও মানসুরা (৭ মাস) ও অজ্ঞাত এক নারীকে জেনারেল হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায় স্বজনরা।
সেই দুর্ঘটনা
৪ এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর চর সৈয়দপুর এলাকার ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। এক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে ট্যাংকার ধাক্কা দেওয়ার ৩০ সেকে-ের মধ্যেই ডুবে যায় লঞ্চটি।
বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক (নৌ নিট্রা) বাবু লাল বৈদ্য জানান, বিকেল ৫টা ৫৬ মিনিটের দিকে প্রায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল ছেড়ে যায় সাবিত আল হাসান নামের লঞ্চটি। সৈয়দপুর এলাকায় শীতলক্ষ্যা ব্রীজের কাছে একটি কোস্টার ট্যাংকারের ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী যা বললেন
ডুবে যাওয়া লঞ্চটি থেকে সাঁতরে তীরে ওঠা মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা শ্রমিক আলম মিয়া জানান, আমি লঞ্চের পেছনের ছাঁদে ছিলাম। হঠাৎ দেখি একটি কার্গো জাহাজ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে আমাদের লঞ্চটিকে ভাসিয়ে ব্রীজের নীচে নিয়ে আসে। পরে লঞ্চটি ডুবে যায়। আমি ছাঁদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হই। কিন্তু লঞ্চে প্রায় ৫০-৬০ জন যাত্রী ছিল। তদের মধ্যে ১৫-২০ জন হয়ত সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছে।
রাতেই ৫ মরদেহ উদ্ধার
রোববার দুর্ঘটনার পর রাতেই ৫নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনার পর প্রচন্ড বৈরি আবহওয়া থাকাতে উদ্ধার কাজে ব্যাঘাত ঘটে। রাতেই উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ঘটনাস্থলে গেলেও স্রোত আর নানা কারণে উদ্ধার করা যায়নি।
স্বজনদের বিক্ষোভ
রোববার রাতে লঞ্চ উদ্ধার কাজ বিলম্বিত হওয়াতে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেন স্বজনেরা। কয়েক দফায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও প্রশাসনের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে যান তারা। একই অবস্থা ছিল সোমবার সকালেও। তাদের অভিযোগ ছিল ইচ্ছা করে লঞ্চ উদ্ধারে কালক্ষেপন করে।
সকাল থেকে উদ্ধার
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, ‘বৈরী আবহওয়ার জন্য রোববার রাতে উদ্ধারকাজ ব্যহত হয়। যার জন্য লঞ্চটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সোমবার সকালে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ দুপুর ১টার দিকে লঞ্চটি উদ্ধার করে। লঞ্চের ভেতর থেকে ওই সময়ে ২২জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
শুধু কান্না আর কান্না
দুপুর ১টার দিকে লঞ্চ উঠার পর শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরে স্বজনরা চিৎকার করতে থেকে। হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দুপুর আড়াইটায় লঞ্চের ভেতর থেকে বের করা লাশগুলো একেক করে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। পরে স্বজনরা একেক করে লাশের পরিচয় শনাক্ত করে।
২৫ হাজার টাকা করে সহায়তা
নারায়ণগঞ্জ সদর নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক জানান, জেলা প্রশাসকের ঘোষণা অনুযায়ী নিহতের দাফন ও সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা সহযোগিতায় দেওয়া হয়েছে। ৩৬ জন নিখোঁজের অভিযোগ পেয়েছি। যার মধ্যে ২৯জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ফলে এখনও ৭জন নিখোঁজ রয়েছে। এখনও কয়েকজন নিখোঁজ আছে স্বজনরা দাবি করছেন। তাদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা ট্রলার দিয়ে আশে পাশেও খোঁজ করবো। এছাড়াও মাইকিং করা হবে যদি কেউ কোন লাশের সন্ধান পায় তাহলে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য।
এদিকে লঞ্চ ডুবির ঘটনায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি মৃণাল কান্তি দাস, বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) জসিম উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।