শহরজুড়ে পরিবহন সিন্ডিকেটে নৈরাজ্য
স্পেশাল করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ০১:৩৩ পিএম, ৩১ অক্টোবর ২০২১ রবিবার

শিল্পাঞ্চল খ্যাত নারায়ণগঞ্জের যাতায়াত ব্যবস্থায় চলছে নৈরাজ্য। ফলে এখানকার যানজট নিত্যদিনকার ঘটনা। কোনো কোনো সময় ছুটির দিনেও নারায়ণগঞ্জের সড়কগুলোতে যানজটে পূর্ণ থাকে। কোথাও নেই কোনো শৃঙ্খলা। অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় ভেঙে পড়েছে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা। পরিবহন সিন্ডিকেটের কাছে যেন অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে এ শহরের মানুষজন। প্রশাসনও যেন নিরূপায় তাদের কাছে।
বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের তথ্য সূত্রে গেছে, ১৯৭১ সাল হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ বিআরটিএ হতে রেজিষ্ট্রেশন করা গাড়ির সংখ্যা সর্বমোট ১১ হাজার ৮০২টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ২২০টি, অটোরিকশা ৬০০১টি, মোটরসাইকেল ২৮৫টি, প্রাইভেটকার ১৮৩টি, পিকআপ ভ্যান ১৯৭টি, ট্যাংক লড়ী ২২০টি, ট্রাক ৮৪০টি এবং ট্রাক্টর ৩৫২টি। কিন্তু বাস্তবে এর কোনোটিই ঠিক নেই। রেজিষ্ট্রেশনকৃত তালিকার কয়েকগুণ বেশি পরিবহন চলাচল করছে নারায়ণগঞ্জের সড়কগুলোতে।
রাস্তাজুড়েই গাড়ি পার্কিং : নারায়ণগঞ্জ শহরের রাস্তায় বের হলেই ৫-১০ মিনিটের রাস্তা যানজটের কারনে যেতে সময় লাগছে ঘণ্টা সমান সময়। আর যানজট সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং। শহরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা একেবারেই নেই বলা চলে। রাস্তার পাশে বিশাল মার্কেট নির্মাণ করলেও সেগুলোতে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। আর যেসকল মার্কেটগুলোর নিচে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলোতে পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান, শো-রুম, রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেয়া হয়েছে।
শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় দীর্ঘ সময় ধরে সড়কের উপরে গাড়িপার্কিং করছে অসংখ্য প্রাইভেটকার, বাইক। নির্দিষ্ট লেনের গাড়িগুলো পর্যাপ্ত জায়গা না পেয়ে আটকে থাকে দীর্ঘসময় ধরে। আর এই পার্কিং করা গাড়িগুলো মূলত মার্কেট, শো-রুম, রেষ্টুরেন্টগুলোতে আসা গ্রাহকদের।
যত্রতত্র অবৈধ স্ট্যান্ড : নারায়ণগঞ্জে শহরে বৈধ তালিকার চেয়ে অবৈধ স্ট্যান্ডের পরিমাণ অনেক বেশী। তাদেরকে যেন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। যত্রতত্র গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্ট্যান্ড। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন কর্তৃক শহরে বৈধ ইজারা দেয়া স্ট্যান্ড রয়েছে মাত্র ৫টি। এগুলো হলো কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, নিউ মেট্রো হল সম্মুখস্থ সড়কে বাস, বেবী ও টেম্পু স্ট্যান্ড, মীর জুমলা রোড বেবী স্ট্যান্ড (বাস টার্মিনাল সংলগ্ন), জিমখানা সড়ক বেবীট্যাক্সি স্ট্যান্ড, চাষাঢ়া শহীদ মিনার সংলগ্ন বেবী স্ট্যান্ড।
এছাড়া বাকী যত স্ট্যান্ড রয়েছে সবগুলোই অবৈধভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়াতেই রয়েছে কমপক্ষে ৮টি অবৈধ স্ট্যান্ড। যার মধ্যে চাষাঢ়ায় খাজা সুপার মার্কেটের সামনে মুক্তারপুরগামী লেগুনা স্ট্যান্ড এবং বিপরীত দিকে সুগন্ধা বেকারীর সামনে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়গামী অবৈধ লেগুনা স্ট্যান্ড। চাষাঢ়ায় রাইফেল ক্লাবের বিপরীতে রয়েছে সাইনবোর্ড গামী একটি অবৈধ লেগুনার স্ট্যান্ড। রাইফেল ক্লাবের পরে আজগর ফিলিং স্টেশনের পাশে রয়েছে অবৈধ একটি সিএনজি ও একটি টেম্পুর স্ট্যান্ড। সরকারী মহিলা কলেজের সামনে বিকল্প সড়কে রয়েছে ফতুল্লা-পাগলাগামী একটি বেবীট্যাক্সির অবৈধ স্ট্যান্ড। ২নং রেলগেট সংলগ্ন ইসলামী ব্যাংকের সামনে, অগ্রনী ব্যাংকের সামনে ও কালিরবাজার এলাকাতেও রয়েছে কয়েকটি বেবীট্যাক্সির অবৈধ স্ট্যান্ড। ওইসকল অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো বছরের পর বছর ধরে বহালই রয়ে যাচ্ছে।
নিয়মনীতি ছাড়াই চলছে বাস : নারায়ণগঞ্জ হতে গাজীপুরের চন্দ্রা রুটে মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট ও নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুর রুটে নিয়মিতভাবে চলাচল করছে গ্রীণ অনাবিল নামের দুটি বাস কোম্পানীর বাস। রুট পারমিট ও ফিটনেস বিহীন গাড়ি গুলো শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী উঠানো-নামানো করে আসছে। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে বড় ছোট দুর্ঘটনা। হাতে গোনা কিছু সংখ্যক বাসের অনুমোদন নিয়ে এক একটি কোম্পানি শতাধিকের বেশি বাস পরিচালনা করছে এই রুটগুলোতে। শহরের মধ্যে কোনো নিদিষ্ট কোন বাস স্ট্যান্ড না থাকার কারনে ও বাসের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অবৈধ ভাবে রাস্তার দুইপাশে এলোমেলো ভাবে গাড়ি গুলো দাঁড় করিয়ে রেখে সরু রাস্তাকে আরো সরু করে রাখে তারা।
এ ব্যপারে বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের সহকারি পরিচালক (ইঞ্জি:) সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী বলেন, গ্রীণ অনাবিল পরিবহনের রুট পারমিট সাইনবোর্ড পযর্ন্ত। এবং আমরা আমাদের নিয়মিত মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করছি। ফিটনেস বিহীন ও রুট পারমিটহীন গাড়ি গুলোকে মামলা করে ডাম্পিং ও জরিমানার আওতায় আনছি।
সড়কেই টিকেট কাউন্টার : নারায়ণগঞ্জের সড়কগুলোতেই বসানো হয়েছে বিভিন্ন পরিবহনের টিকেট কাউন্টার। রাস্তার এক কিনারেই তারা ছোট টেবিল বসিয়ে টিকেট বিক্রয় করছেন। ক্রেতারাও রাস্তাজুড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকেট ক্রয় করছেন। যা জানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
অবৈধ ইজিবাইকের দৌরাত্ম্য : নারায়ণগঞ্জ শহরের সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, লেগুনা। শহরের জিমখানা মোড়, ডিআইটি, ২ নম্বর রেল গেইট চত্বর, গলাচিপা, ১ নম্বর রেল গেইট, কালিরবাজার, চাষাঢ়া মোড়ে সোনালী ব্যাংকের সামনে, খাঁজা মার্কেটের পেছনে, শহীদ মিনারের সামনে ও পার্শ্বে, সরকারি মহিলা কলেজের সামনে, চাষাঢ়া রেল স্টেশনের সামনে, চাষাঢ়া চত্বর সুগন্ধা বেকারির সামনে গেলেই দেখা মিলবে অবৈধ ইজিবাইক নিয়মিত যাতায়াত করছে। তারা সড়ক দখল করেই যাত্রী উঠা নামা করছেন। সেই সাথে এসব অবৈধ ইজিবাইকের অধিকাংশ চালক অনভিজ্ঞ। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। অনেকে ক্ষেত্রে ইজিবাইক কমবয়সী কিশোর এমনকি শিশুদেরও ড্রাইভিং সিটে করতে দেখা যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের বক্তব্য : নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘সড়কে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে আমাদের বিআরটিএর মাধ্যমে কাজ করছে ট্রাফিক পুলিশ জেলা পুলিশ এবং আমাদের মোবাইল কোর্ট। নারায়ণগঞ্জ শহরে আসলে যানজট আছে। কেননা এখানে প্রচুর পরিমাণে জনসংখ্যা এবং গাড়ির সংখ্যা অনেক। সেই সাথে অনেকগুলো উন্নয়ন কর্মককান্ড পরিচালিত হচ্ছে। সাইনবোর্ড থেকে চাষাঢ়া মোড় পর্যন্ত রাস্তাটা ১৪৩ ফিটের মতো চওড়া হচ্ছে। আর অবৈধ স্ট্যান্ড যেগুলো রয়েছে সেগুলো উচ্ছেদ করার জন্য আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে কিছু কাজ আমরা করছি। এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আর ইজিবাইকের বিষয়টি সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত দেয় আইন এবং বিধি অনুযায়ী আমরা সেটা বাস্তবায়ন করবো।’