বিএনপি হেফাজতে ভাগাভাগি

স্পেশাল করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ০৯:৪৯ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০২১ সোমবার

বিএনপি হেফাজতে ভাগাভাগি

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নৌকা পেয়েও ইতোমধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন মতিউর রহমান। সেখানে নৌকা পেয়েছেন জাকির হোসেন। স্বতন্ত্র লড়বেন সায়েম আহমেদ। যদিও এ তিনজনের কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন না সাফ জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই। এ কারণে তিনি কেন্দ্রে পাঠানো চিঠিতে তিনি সাক্ষর করেনি। এদিকে জাকির হোসেন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন হেফাজত নেতাদের নিয়ে। আর সায়েমের গোড়া বিএনপির।

১৬ অক্টোবর রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়ন পত্র জমা দেন জাকির হোসেন। সদর উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের নিয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাকির হোসেনকে ফুলের নৌকা তুলে দেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক প্রচার সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজতে ইসলামের সমন্বয়ক মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান। ওই সময় হেফাজতে ইসলামের আরো বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, কয়েক মাস পূর্বে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেনকে নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামেন বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক প্রচার সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজত ইসলামের সমন্বয়ক মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও জাকির হোসেনকে নিয়ে প্রচারণা চালান ফেরদাউসুর রহমান। পরবর্তীতে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেখানে জাকির হোসেনকে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চাওয়ার দাবি তোলা হয়। যে অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন জাকির হোসেন ও উদ্যোক্তা ছিলেন মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েকদিন পূর্বে নগরীর পাইকপাড়ার নয়াপায়া এলাকায় মহাজোটের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ একেএম সেলিম ওসমানের নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চলে। নির্বাচনের বানচালের চেষ্টায় সংঘটিত ওই ঘটনায় ২৫ ডিসেম্বর সাংসদের অনুসারী এনামুল হক রিয়াজ মামলা করেন। ওই মামলায় ৭৪ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়। মামলার ৭৪ নম্বর আসামি জাকির হোসেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, জাকিরসহ এজাহারনামীয় ৭৪ জনসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১৫ জন আসামি মহাজোটের প্রার্থী সেলিম ওসমানের পাইকপাড়ার নয়াপাড়া ক্যাম্পে হামলা করে। ক্যাম্পের ভেতর বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংযুক্ত পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে। ক্যাম্পে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেই আগুন নেভায় ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজন। ক্যাম্পে থাকা অডিও প্লেয়ার, মাইক লুট করে আসামিরা।

আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা, ভাঙচুর ও বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার মতো ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন জাকির হোসেন। সেই মামলায় আসামিও হন তিনি। হেফাজতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অথচ তাকেই আবার দলীয় মনোনয়নে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী এক নেতার কারণে সহিংসতা মামলার আসামির ঝুলিতে নৌকার মনোনয়ন উঠেছে।

নারায়ণগঞ্জ সদর থানার আলীরটেক ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সায়েম আহমেদ স্বেচ্ছাসেবক দলের রজানীতির সাথে জড়িত ছিল। দলীয় মিটিং মিছিলে নিয়মিত উপস্থিতি ছিল সায়েমের। নারায়ণগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের সূত্রে এরুপ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে বিএনপির ছাত্রদল থেকে বিএনপি বিভিন্ন সংগঠনের পদ পদবী হাসিলের নানা চেষ্টা করে গেছে। যেকারণে বিএনপির বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলে অংশগ্রহণ করেছে। তবে টানা তিন মেয়াদে বিএনপি দলীয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় ভোল পাল্টে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন বিতর্কিত নেতা সায়েম। এখানেই শেষ নয় তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকা-ের অন্ত নেই। সরকার বিরোধী কর্মকান্ড থেকে শুরু করে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি ভোল পাল্টে আওয়ামীলীগের যোগদানের পরে আলীরটেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছিলেন সায়েম। শেষতক সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আরেক বিতর্কিত নেতা ও বর্তমান চেয়ারম্যান মতিউর রহমান নৌকার মনোনয়ন পেয়ে যান। এতে করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পত্র দাখিল করেন সায়েম।

এদিকে সায়েম এক সময়ে বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল যার প্রমাণ হিসেবে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিএনপির ছাত্র সংগঠনের একটি অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে। তবে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল কিনা সেই তথ্য জানতে বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করা হয়।

এ ব্যাপারে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আকরাম প্রধান সময়ের নারায়ণগঞ্জকে বলেন, এক সময়ে সায়েম আমার মিটিং মিছিলে আসতো। ২০১০, ১২ ও ১৪ সালের দিকেও সায়েম আসতো। ওই সময়ে আমি জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক পদে ছিলাম। সায়েম আমার স্বেচ্ছাসেবক দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছেলে পেলে নিয়ে আসতো।

বিএনপি দলীয় সূত্র বলছে, সায়েম বিএনপি বিভিন্ন সংগঠনের মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করতো। পদ পদবী হাসিলের জন্য নানা সময়ে চেষ্টাও করেছে। যখন যে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পেরেছে তখন সেই সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগদান করতো। কারণ পদ পদবী হাসিল করা ছিল তার মূল লক্ষ্য।

জানা যায়, আলীরটেক ইউপি নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান মতিউর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ও সায়েম আহমেদ। কিন্তু এদের কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নেই। চেয়ারম্যান হওয়ার আশায় তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আর এ বিষয়টি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আব্দুল হাই মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি স্বাক্ষরও করেননি। কিন্তু তার স্বাক্ষর ছাড়াই এসকল নাম কেন্দ্রে জমা পড়েছে। যদিও শেষে মতিউর রহমান মতি পেয়েছেন নৌকার মনোনয়ন।

জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়নে এবার চেয়ারম্যান হতে চাওয়া সেই সায়েম আহমেদের বিরুদ্ধে সদর মডেল থানা ও মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় চাঁদাবাজি, মারামারি, হত্যাচেষ্টা, হত্যার উদ্দেশ্যে গুম ইত্যাদি অভিযোগে বেশি কিছু মামলা আছে এবং একটি মামলায় তিনি জেলও খেটেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ৩ মে গণভবন থেকে উদ্বোধন করেন কুড়েরপাড়ে ৫২ দশমিক ৫ মেগাওয়াটের সিনহা পিপলস এনার্জি লিমিটেডের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের। ১০ মে সিনহা পিপলস এনার্জির সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) শাহাবুদ্দিন আহমেদ নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় জিডিতে বলেন, বিদ্যুকেন্দ্রের নিজস্ব জেটির সামনে সায়েম, কাশেম, শাহ আলম, মো. আলী ৭ মে খালি বার্জ ও লাইটারেজ জাহাজ নোঙর করে রাখেন যাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জাহাজ জেটিতে ভিড়তে না পারে। সন্ত্রাসীরা বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি তেল সরবরাহ ও কেন্দ্রে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

দৈনিক কালের কণ্ঠের এক সংবাদ মতে আলীরটেক ইউনিয়নের কুড়েরপাড় এলাকার সায়েম আহমেদকে এক যুগ আগেও লোকজন চিনত নুরু মিয়া নামে। বিদ্যালয়েও এই নাম ছিল তাঁর। তবে শহরের বাবুরাইল এলাকার প্রভাবশালী পরিবারে বিয়ের পর নাম পাল্টে বনে যান সায়েম আহমেদ।

নারায়ণগঞ্জ সদর থানা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা সওদাগর খান বলেন, সায়েম বিএনপি কোন সংগঠনের সদস্য কিনা তা নিশ্চিত নই। তবে একটা ছবি দেখেছি। সেটা ব্যবসার খাতিরে বিএনপির আমলে একটা অনুষ্ঠানে সায়েম উপস্থিত ছিল। সায়েমও আমাকে ছবির ব্যাপারে এ জবাব দিয়েছে।


বিভাগ : রাজনীতি


নিউজ নারায়ণগঞ্জ এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আরো খবর
এই বিভাগের আরও