হাজীর সাহেবের সেনাপতিদের উত্থান পতন
স্টাফ করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ০১:১৫ পিএম, ৩১ অক্টোবর ২০২১ রবিবার

নারায়ণগঞ্জের প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের একমাত্র ছেলে আজমেরী ওসমানের বিশাল একটি কর্মীবাহিনী রয়েছে। আর এ বাহিনীর লোকজদের নিয়ন্ত্রনে প্রায়শই পরিবর্তন ঘটে সেনাপতিদের। তাদের যখন কেউ দায়িত্ব পান তখন হয়ে যান অপ্রতিরোধ্য। ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। কিন্তু যখন পতন ঘটে তখন পড়নের কাপড় ছাড়া আর কিছুই থাকে না। গত কয়েক বছরে এমন সেনাপতিদের কয়েক দফা পরিবর্তন উত্থান পতনের ঘটনা ঘটেছে। তবে ঘুরেফিরে আবার তাদের নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটেছে। সবশেষ আবারো এ সেনাপতির দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন তরিকুল ইসলাম লিমন। অথচ গত জুনেও গ্রেপ্তার হন। গিয়েছেন কারাগারে। যখন আদালতে তোলা হয় তখন তিনি দুই চোখ মুছেন। অঝোর ধারায় বেয়ে পড়ে অশ্রু। গত ২২ অক্টোবর শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে এ লিমন বাহিনীর হামলায় আহত হয়েছেন বজলুর রহমান ওরফে হাজী রিপন ও তার লোকজন। কারণ গত জুনে যখন লিমনকে মারধর করা হয় তখন তার নেতৃত্বে ছিলেন এ রিপন ও তার লোকজন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক বছরে ওই সাম্রাজ্যের সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন ফুডল্যান্ডের হাবিব, খানপুরের আকতার, হাজী রিপন ও লিমন।
হাজী রিপন : নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সমালোচিতদের একজন বজলুর রহমান ওরফে হাজী রিপন। জাতীয় পার্টির এক সময়ে এর নেতা নিজ দল থেকেও বহিস্কৃত। ফেনসিডিল সহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ডিবির অভিযানে। এছাড়া নারী কেলেংকারীও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ছেলে সীমান্ত হলেন আলোচিত মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলখাটা আসামী। হাজী রিপনকে গত বছর নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্রাক ট্যাংকলরী ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নং ঢাকা-২৫৫৮) এর সেক্রেটারী হয়।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে নিতাইগঞ্জের ট্রাক কভার্ডভ্যান ট্যাঙ্কলরীর চালক ইউনিয়নের সভাপতি বনে গিয়ে আলোচনায় আসেন হাজী বজলুর রহমান রিপন ওরফে হাজী রিপন। নিতাইগঞ্জের ট্রাক স্ট্যান্ড পঞ্চবটিতে স্থানান্তর নিয়ে বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র (বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র) ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে হাজী রিপনের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় ব্যাপক আলোচিত সমালোচিত হন হাজী রিপন। এছাড়া ট্রাকস্ট্যান্ড স্থানান্তর নিয়ে ট্রাক শ্রমিকদের ও এলাকাবাসীর মধ্যকার সংঘর্ষের ঘটনায় উস্কানীদাতা হিসেবেও আলোচিত ছিলেন। এছাড়া ট্রাক শ্রমিকদের থেকে বেপরোয়া চাঁদা দাবির অভিযোগ তো ছিলই। তাছাড়া সুতা ডাকাতি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডেরও অভিযোগ উঠেছিল হাজী রিপনের বিরুদ্ধে।
২০১০ সালে বাংলাদেশ হোসিয়ারী এসোসিয়েশনের সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়ার পরে ক্ষমতার দাপটে এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি বিচার শালিস কমিটির চেয়ারম্যান বনে গিয়ে হোসিয়ারী ব্যবসায়ীদেরকে নাজেহাল করারও অভিযোগ ছিল হাজী রিপনের বিরুদ্ধে।
এর কিছুদিন পরেই ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারী শহরের পাইকপাড়ায় বিউটি পার্লারে অভিসারে গিয়ে নারীসহ জনতার হাতে আটকের পর লাঞ্ছিত হওয়ার পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করে।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ আলোচিত ত্বকী হত্যাকান্ডের ঘটনায় হাজী রিপনের জামতলাস্থ বাসভবনে র্যাব-১১ এর অভিযান ও বড় ছেলে সালেহ রহমান সীমান্তের গ্রেফতারের পরে আবারো আলোচনায় আসেন হাজী রিপন। তবে নানা ঘটনার পরিক্রমায় ট্রাক চালক ইউনিয়নের সভাপতির পদে হাজী রিপনের আধিপত্য নেমে এসেছিল তলানীতে।
২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ ট্রাক ট্যাঙ্কলরী কভার্ডভ্যান শ্রমিক কমিটির সভাপতি হাজী বজলুর রহমান রিপন বিরুদ্ধে মারধারের অভিযোগ এনে থানায় মামলা করেছেন তারই বন্ধু ও ব্যবাসয় র্পটনার এজাজ আহমেদ। ওইদিন রাতে নিজে বাদী হয়ে হাজী রিপন, মিঠু, শাহিন, টিটুসহ আরো কয়েকজনকে অজ্ঞাত করে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন।
এরপর রাজনীতি ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে ছিটকে পড়া হাজী রিপনের বিরুদ্ধে জামতলা এলাকায় মাদক ব্যবসার অভিযোগও উঠেছিল। কয়েক বছর আগে জামতলা হাজী ব্রাদার্স সড়ক এলাকা থেকে ২শ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ মৃত আ. কুদ্দুস মাদবরের ছেলে বহিস্কৃত জাপা নেতা হাজী বজলুর রহমান রিপন (৫৪) ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে জামতলা এলাকায় মাদক বেচাকেনার অভিযোগ ছিল।
সদর মডেল থানর উপ-পরিদর্শক আজহারুল ইসলাম জানান, সদর উপজেলার বারীর টেক কোরবানী গরুর হাটে চাদাবাজি করার ঘটনায় সোহেল বাদী সদর মডেল থানায় চাঁদাবাজি একটি মামলা দায়ের করেছিল। সে মামলার আসামি আরমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পলাতক রয়েছে হাজী রিপন।
এর আগে গত মার্চে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান প্রীতমকে পিটিয়ে ও রক্তাক্ত জখম করেছে একদল সন্ত্রাসী। এ হামলার নেতৃত্ব দেন বহু মামলার আসামী বিতর্কিত হাজী রিপন। এ বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল।
ওইদিন লিখিত অভিযোগে সাংবাদিক প্রীতম উল্লেখ করেন, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা থানাধীন লিংক রোডে অবস্থিত জেলা কারাগারের বিপরীতে একটি জমির উপর নির্মিত দোকানপাটে ভাঙ্গচুর ও লুটপাট চালানোর সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজের নিকন ডি ৭০০ মডেলের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেন তিনি। ছবি তুলতে দেখে সন্ত্রাসীরা তার দিকে তেড়ে আসে, পরে সে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলে এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী খ্যাত হাজী রিপন তার হাতে থাকা লোহার হাতল দ্বারা সাংবাদিক প্রীতমের মাথায় আঘাত করে রক্তক্ষরণ ঘটায়। একইসময়ে কাউন্সিলর শফিউদ্দিন প্রধান ও হারুন অর রশিদ এবং ৪০/৫০ জন হামলাকারী লোহার রড, লোহার পাইপ, কাঠ, বাঁশসহ দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র দ্বারা তাকে বেদম মারধর করে রক্তাত্ব জখমসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে তার সাথে থাকা নিকন ডি ৭০০ মডেলের ক্যামেরা, স্যামসাং এম ২১ মডেলের একটি স্মার্টফোন, পকেটে থাকা আট হাজার ৩০০ টাকা, জাতীয় পরিচয় পত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের মূল কপিসহ মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এসময় তার মাথা ফাটিয়ে, হাত ভাঙ্গা, পিঠে অজস্র কাটা, রক্তাত্ব জখমসহ শরীরের সকল স্থানে নীলাফুলা জখম করে।
লিমন : ২৭ জুন বিকেলে শহরের মাসদাইর এলাকার বাসা থেকে তাকে ও তার শ্যালককে গ্রেপ্তার কর হয়। ধরাকে সরা জ্ঞান করলো কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। এক পর্যায়ে মাসখানেক আগে আজমেরী ওসমান তাকে বিতাড়িত করে।
জানা গেছে, মুকিদ নামে এক ব্যক্তি লিমনের কাছে টাকা পাবে। মুকিদ ও আক্তার নূর নামে দুইজন মাসদাইরে লিমনের বাড়িতে যায় পাওনা টাকা চাইতে। ওই সময়ে লিমন ও তার শ্যালক হিজবুল্লাহ ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের মারধর করতে চায়। তখন তারাও ক্ষিপ্ত হলে লিমনের শ্যালক হিজবুল্লা চাপাতি দিয়ে আক্তার নূরকে কোপায়। এসময় তাদের চিৎকারে এলাকাবাসী ছুটে এসে লিমন ও তার শ্যালক হিজবুল্লাহকে চাপাতিসহ আটক করে পুলিশে দেয়। এঘটনায় মুকিদ বাদী হয়ে মামলা করেছে।
হাবিব : দুই বছর আগেই মূলত সেনাপতির পদ হারান হাবিব। ওই সালের মার্চে লিমন, দারুন, রমজান, পিন্টু ও শিপলুসহ অজ্ঞাতনামা ২৮/৩০ জনকে আসামী করে মামলা করেন হাবিব। এর পরেই মূলত হাবিব আর ফ্রন্টলাইনে যেতে পারেনি।
আদি ফুডল্যান্ডের হামলার ঘটনার পরপরই মালিক হাবিবুর রহমান হাবিব অভিযোগ করেন, গত রমজান মাসেও তার উপর অত্যাচার করেছে সন্ত্রাসীরা। লিমন তার মাথায় পিস্তল ধরে ডিসবাবুর (১৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর) অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে বেধরক মারধর করে সন্ত্রাসীরা। ডিসবাবুর সামনেই সন্ত্রাসীরা তাকে মারধর করে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। লিমন তার বাহিনী নিয়ে হাবিবের প্রতিষ্ঠানে (ফুডল্যান্ড) শোরুম, ফ্যাক্টরী ও অফিসে হামলা চালিয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। এছাড়া ক্যাশ থেকে ৬ লাখ টাকা লুট করে। সকল আসবাবপত্র, ৩টি টেলিভিশন, ফ্রিজ ভেঙেছে। অফিসের সামনে থাকা ২টি মোটরসাইকেলও তারা ভেঙে দিয়েছে।