প্রতিকূলতার পরেও এগিয়ে চলেছেন নারায়ণগঞ্জের নারী সাংবাদিকেরা
স্টাফ করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ০৯:৪৯ পিএম, ২৮ জুন ২০২০ রবিবার

১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশে নারীদের জন্য প্রথম গড়ে তোলা হয়েছিল বেগম পত্রিকা। সূচনা লগ্নে এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন নূরজাহান বেগম। তখন নারীদের চাকরি করাটাই একটা ট্যাবু ছিল। একজন নারী ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করবে তা আমাদের সমাজ এবং পরিবার মেনে নিতে পারতো না। এখনো যে আমরা সে পরিস্থিতি থেকে বের হতে পেরেছি, তা নয়। আর যেখানে সাংবাদিকতা বেশ চ্যালেঞ্জিং একটি পেশা! সেখানে সমাজের এবং পরিবারের সকল বাধা অতিক্রম করে একজন নারীর পক্ষে এ পেশা গ্রহন করা যেন আরও মুশকিল!
তবে ৭ দশক পরে এসে সাংবাদিকতায় নারীদের অংশগ্রহন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সমাজ তাদের কাজকে গ্রহন করছে। তবে সাংবাদিকতায় নিজেদের যায়গা করে নেয়ায় লড়াইটা এখনো চালিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। এমনকি করোনার শুরু থেকেই সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই সাংবাদিকতার পাশাপাশি মানবতাবোধ থেকে জনগণের সেবায় বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে নারীরাও থেমে নেই। তারাও সর্বোচ্চটুকু দিয়েই কাজ করে যাচ্ছে।
সে সমস্ত লড়াইয়ের কথা উঠে এসেছে নিউজ নারায়ণগঞ্জের ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠান, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে নারী সাংবাদিকদের ভূমিকা ও লড়াই’এ।
২৭ জুন রোববার ১০টায় এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি, দৈনিক সংবাদের সহ সম্পাদক আফরিন আহমেদ হিয়া, প্রেস নারায়ণগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক আফসানা আক্তার। সঞ্চালনায় ছিলেন হাফসা আক্তার।
গত ২০ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জে মাঠ পর্যায়ে সাংবাদিকতা করছেন সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি। যখন নারায়ণগঞ্জে মাঠ পর্যায়ে কোনো নারী সাংবাদিক কাজ করছে তা ভাবাও মুশকিল ছিল। গত ২০ বছরে নারীদের জন্য সাংবাদিকতা কেমন ছিল এবং কতটা পরিবর্তন এসেছে, সে বিষয়ে আলোচনা করেন তিনি।
সাংবাদিকতায় নারী হিসেবে তিনি তার জীবনের বাধার শিকার হওয়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করেন, ‘সে সময় এক মাদক ব্যবসায়ীর বিষয়ে লেখালেখি করি। আমার সম্পাদকও আমাকে উৎসাহ দেন। লেখার পরে দেখি যে আমার সম্পাদক সে মাদক ব্যবসায়ীর টাকার সাথে সমঝোতা করে নিয়েছেন। এমনকি আমার পাশের যে পুরুষ সাংবাদিক কাজ করছেন, তিনিও প্রতি মাসে মাদক ব্যবসায়ীটির কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে আড়াল করে যাচ্ছেন। যখন আমি লিখতে যাই, তখন তিনি খুব নোংরা ভাবে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। আমি তখন নিতাইগঞ্জের দিকে মাদক বিষয়ে কাজ করছিলাম।’
প্রীতি আরো বলেন, ‘দিনটি ছিল ২০০৫ সালের ১০ই অক্টোবর। দিনটি একটি অভিশপ্ত দিন ছিল। যা মনে পরলেই আমার ভিতরটা এখনো কেপে উঠে। সেদিন ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে একট প্রতিবেদন নিয়ে ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন আমার সহকর্মীটি আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, “প্রীতি তুমি কোন ছেলের সাথে হাসপাতালে কোন রুমের ভিতরে আছো?” ঠিক সে সময়ই কোথা থেকে অনেকগুলো ফটো সাংবাদিকও এসে উপস্থিত হয়। অথচ আমি তখন ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে বসে নোট করছিলাম যে কতজন রোগী আছে এবং পরিস্থিতি কি?
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন কাজ করেছি, তখন সব জায়গায় আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো যে, নারায়ণগঞ্জের একমাত্র নারী সাংবাদিক। অথচ আজ আমরা দেখছি স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়েও আমাদের জেলার মেয়েরা কাজ করছে। ঝড় আসবেই। তবে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সে ঝড়ের মোকাবেলা করতে হবে। নিজের লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে। লক্ষ স্থির থাকলে জয় সুনিশ্চিত।’
গত ৪ বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন তরুন সাংবাদিক আফরিন আহমেদ হিয়া। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও তিনি নিয়োমিত ঢাকায় যাতায়াত কাজ করে যাচ্ছেন। তরুণ সাংবাদিক হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতে লড়াই সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একজন নারী যখন কোনো কাজ করে তখন তার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। নিজের পরিবারকে বুঝিয়ে, নিজের সঙ্গীকে বুঝিয়ে, সমাজকে উতরে গিয়ে কখনো যদি কাজ করতে যান, তখন অবশ্যই একজন পুরুষের তুলনায় আপনার বেশি সামর্থ্য দিয়ে আপনাকে কাজ করতে হয়। আপনি যখন সংবাদের তথ্য সংগ্রহ করতে যান তখন সেই তথ্যের জন্য আপনাকে সমাজে একটি ন্যায্যতা তৈরি করতে হয়। যাতে কেউ যেন একটা গালি না দেয় বা বাজে ভাষায় কথা না বলে। একজন পুরুষের মতো সব সময় সব জায়গায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহে একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। ফলে সে বিষয়েও আমাদের সচেতন থাকতে হয়। সেদিক থেকে আমি বলব যে পুরুষ সাংবাদিকের তুলনায় নারীকে বেশি বাধা অতিক্রম করতে হয়। ফলে এ বিষয়টিকে নজর আন্দাজ করা ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন সাংবাদকতা শুরু করেছিলাম, তখন আমার আশেপাশে কোনো নারী সাংবাদিক বন্ধু ছিল না। চারিদিকে সবাই পুরুষ সাংবাদিক এবং তারা তাদের সঙ্গে একজন নারীকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন না। ফলে একজন নারীকে তাদের সঙ্গে কাজ করতে দেখতে এবং তাকে গ্রহণ করতে শুরুতে তারা একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এই কয় বছরে আমি তার পরিবর্তন দেখছি। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ শহরে অনেক নারীরা সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।
অথচ এর আগে নারীদের সাংবাদিকতা নিয়ে নারায়ণগঞ্জে টক শো বা কোনো কলাম লেখালেখিও আমি দেখিনি বা আমার চোখে পড়েনি। তবে এখন মানুষের সামনে তা উঠে আসছে। কারণ নারীরা কাজ করছে এবং সে কাজ মানুষ গ্রহন করছে। এর মধ্য দিয়ে ইতোপূর্বে যারা কাজ করেছে এবং যারা কাজ করছে তাদের বিষয়টিও উঠে আসছে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিকে আমি ইতিবাচক ভাবেই পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এই পরিস্থিতি কেমন পরিবর্তন হবে তা নির্ভর করে আমাদের কাজের উপরে।’
সাংবাদিক স্বামীর উৎসাহ এবং সহায়তায় এ পেশায় যুক্ত হন তরুণ সাংবাদিক আফসানা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমার শ্বশুর বাড়ির পরিবার আমার এবং আমার স্বামীর এ পেশায় কাজ করাটাকে মেনে নিয়েছে। কারণ তারা জানে তাদের ছেলে সব সময়ই আমার সুরক্ষার জন্য আমার সঙ্গে থাকে। কিন্তু আমার নিজের বাবা এখনো তা মেনে নিতে পারেনি। তিনি বুঝিয়ে হোক বা জোর করেই হোক, আমার সাংবাদিকতা পেশা ছাড়তে বাধ্য করতে চান।
আমার স্বামী ইতোমধ্যে পেশাগত কারণে দুইবার হামলার শিকার হয়েছে। ফলে আমার পরিবার আমাকে বলে যে, আমার স্বামী সে হামলা সহ্য করতে পারলেও আমার আমি তা পারবো না। অথচ কেমন যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি তা জানার প্রয়োজন তারা মনে করে না। কারণ তাদের ধারণা সাংবাদিকতার বাধা শুধু পুরুষের জন্য নারীরা সে বাধা সহ্য করতে পারে না বা পারবে না। তবে এঝখন তাদের এই ভ্রান্ত ধারণা দুর করতেই আমার লড়াই।’