সামাজিক অবক্ষয় পারিবারিক উদাসীনতায় কিশোর গ্যাং তৈরি
স্টাফ করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ০৯:২২ পিএম, ১৫ আগস্ট ২০২০ শনিবার

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’ এর উৎপাত। এলাকায় আধিপত্ব বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিছুদিন পর পরেই এসব কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রুপের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সবশেষ বন্দরে কিশোর গ্যাংয়ের ধাওয়ায় বন্দরের ইস্পানি ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাপ নিয়ে আর উঠতে না পেরে মৃত্যু হয় দুই শিক্ষার্থীর। কিন্তু কিভাবে কিশোর গ্যাং তৈরী হচ্ছে? কেনই বা তাঁরা এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠছে? এর থেকে নিস্তারের উপায়-ই বা কি? এসব বিষয় উঠে এসেছে নিউজ নারায়ণগঞ্জের লাইভ টকশো অনুষ্ঠানে।
১৪ জুলাই শুক্রবার রাত ৯টায় নিউজ নারায়ণগঞ্জের লাইভ টকশো ‘কিশোর গ্যাং ও বন্দরে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু’ অনুষ্ঠানে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে উপস্থিত ছিলেন বন্দর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বিএম স্কুলের অভিভাবক প্রতিনিধি মহিউদ্দিন সিদ্দিকী এবং নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবী শরীফুল ইসলাম শিপলু। সঞ্চালনায় ছিলেন আরিফ হোসেন কনক।
অনুষ্ঠানে বন্দর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বিএম স্কুলের অভিভাবক প্রতিনিধি মহিউদ্দিন সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের ইস্পাহানিতে অন্তত ১০০ নৌকা আছে। সেগুলোর সাথে ১০০ কিশোর হেল্পার আছে। নবীগঞ্জ থেকে বন্দর ২০০ অটো আছে। অর্ধেক কিশোর বয়সের চালক। দেখা গেছে অটো চালিয়ে একজনের সংসার সুন্দরভাবে চালাতে পারে। কিছু কিছু ছেলে আছে যারা বাসা বাড়িতে যায় না। গ্যারেজে ঘুমায়। মাদকের সাথে জড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ তাঁরা অটো চালায় এবং নৌকায় যায় শুধু মাদক সেবনের জন্য।’
তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা হলেই কামাল উদ্দীন মোড় থেকে বন্দর খানবাড়ি এবং রাজ বাড়ি পর্যন্ত চারজন ছয়জনের অন্তত কয়েকশ গ্রুপ আছে। আগে আমাদের সন্ধ্যার পরে বাড়িতে না গেলে অনেকে বলতো বাড়িতে যেতে। কিন্তু পঞ্চায়েত ব্যবস্থা না থাকায় সেটা হয় না। আমাদের সময়ের যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল। এই মুহূর্তে এটা নাই। আবার অনেক অভিভাবক কিশোরদের উৎসাহ দিতে মোটরসাইকেল কিনে দেয়। দেখা যায় বিকট শব্দে দুইজন তিনজন বন্ধু মিলে এলাকায় ঘুরছে। এই শব্দে আমরা থাকতে পারি না। কিন্তু পুলিশের কানে এই শব্দ যায় না। যদিও পুলিশের যে লোকবল আর আমাদের যে জনসংখ্যা। কিছু করার উপায় নেই। আমরা যতি সচেতন না হই। আমরা যদি ব্যবস্থা না নেই। তাহলে দিনদিন আমাদের অবস্থা কিন্তু খারাপের দিকে যাবে।’
নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবী শরীফুল ইসলাম শিপলু বলেন, ‘কিশোর গ্যাং আমাদের সমাজে নতুন ট্রেন্ড তৈরী হয়েছে। এটা হচ্ছে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। আমি নিজেকে দিয়ে উদাহরণ দিব। আমাদের সময় অভিভাবকদের যে অনুশাসন ছিল। যেমন মাগরিবের আগে আমাদেরকে বাসায় আসতে হতো। আমাদের অভিভাবকেরা এলাকার চাচা কিংবা বড় ভাইদেরকে বলা ছিল যে যদি অপরাধ দেখেন ওদেরকে রাস্তায় শাসন করে দিবেন। ওরা আপনাদেরই সন্তান। কিন্তু এখন পরিস্থিতি হয়ে গেছে যে এখন রাস্তায় একটা ছেলেকে ধমক দিতে গেলে উল্টা তাঁর বাবা এসে ধমক দেয় যে বাপ কি মারা গেছে নাকি?’
তিনি আরো বলেন, ‘অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের প্রতি উদাসীন। তাঁরা সময় দেয় না। যে কারণে কিশোর ছেলেগুলো তাঁদের বন্ধুদের সাথে অনেক সময় কাটাচ্ছে। রাতে কখন বাসায় আসছে বাবা মা খবর নিচ্ছে না। এভাবে তাঁরা বিভিন্ন গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। এটাতে উচ্চ বিত্ত পরিবার এবং নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও জড়িয়ে পড়ছে।’
শিপলু বলেন, ‘আমাদের বয়সের একটি লোক যদি অপরাধে জড়ায় এটার দায় দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু একটি কিশোর যদি অপরাধের সাথে জড়ায় বা সন্ধ্যার পর বাসায় যাবে না। এটার দায় দায়িত্ব কিন্তু কিশোরের না। কারণ তাঁরা ইনোসেন্ট। তাঁরা নাটকিয়তার মাধ্যমে জড়িয়ে গেছে। অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে জড়িয়ে গেছে। তাঁরা বন্ধুরা একসাথে ঘুরলো একটা গ্যাং তৈরী করলো। এলাকায় প্রভাব বিস্তারের আশা, ক্ষমতার দাপট দেখানোর আশা, কোনো বড় ভাইয়ের পেছনে থাকার আশায়। গ্যাংদের সাথে যারা থাকে তাঁদের ফেসবুক ঘাটলে দেখা যায় কোনো না কোনো বড় ভাইয়ের সাথে সেলফি আছেই। এরা কিন্তু নিজেদের এলাকাতে ক্ষমতাধর হিসেবে পরিচিতদ করতে গিয়েই ছোট ছোট গ্রুপের সাথে সংঘর্ষ ঘটাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘তাঁদের দেখাশোনার দায়িত্ব কিন্তু অভিভাবকের এবং অভিভাবকদেরকে এলাকার যারা মুরুব্বি বা পঞ্চায়েতের মুরুব্বিদেরকে বলতে হবে যে আপনার ভাতিজার কোনো অপরাধ দেখলে দুইটা চড় দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিবেন। আপনারাই শাসন করে দিবেন। কিন্তু এই শাসনটি কিন্তু হয় না। এখন স্কুলের বাচ্চাদেরকেও যদি শিক্ষকরা মারে অভিভাবকরা গিয়ে বলে যে আপনারা হাতে কেন মারলেন? পায়ে কেন মারলেন? আপনারা তো পারতেন আমাদেরকে জানাতে। একটি আইন আছে। কিন্তু তাঁরা আইনের আশ্রয় না নিয়ে স্কুলে গিয়ে চিল্লাচিল্লি করে।’
তিনি বলেন, ‘কিশোর গ্যাং দমানোর ব্যাপারে প্রশাসনের একটি ভূমিকা আছে। যেমন উচ্চ বিত্ত পরিবারের পাশাপাশি নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও কিন্তু জড়ায়। তাঁদের কাছে অস্ত্র আসে কিভাবে? তাঁরা একটা সময় মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ে। আর মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়লে একটি ফাইন্যান্সিয়াল ব্যাকআপের প্রয়োজন আছে। এই ফাইন্যান্সিয়ার ব্যাকআপ তাঁরা কোত্থেকে পায়? সবাই তো আর বড় ভাইয়ের সাথে শেল্টার নিতে পারে না। দেখা যায় যে ছোটখাটো খুপড়ি দোকান বা ফাস্টফুডের দোকান। যেগুলো কিশোর বন্ধুবান্ধবরা মিলে চালায়। এই টাকাটা কি আসলে ফ্যামিলির পিছনে যায় নাকি মাদকের পিছনে যায় নাকি অস্ত্রের পিছনে যায়। এটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু সিটি প্রশাসনের আছে যে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া কিভাবে দোকান বসালো? এরপর পুলিশের দায়িত্ব আছে যে এরা ব্যবসা করছে এই টাকা ফ্যামিলিতে নাকি মাদক বা গ্যাংয়ের পিছনে যাচ্ছে এগুলো দেখার। এগুলো কিন্তু সুযোগ করে দেয় কিশোর গ্যাংগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। একটি ছেলে অদ্ভুত চুলের কাটিং করে বাড়িতে যায়। তাঁর বাবা মা কি দেখে না? ওই ছেলেটা কি এমন ব্যবসা করে যে বাইক চাইলেই কিনে দিতে হবে? এগুলো কিন্তু টোটাল দায়িত্ব পরিবারের।’