জিন্সের প্যান্ট শার্ট খুলে পাঞ্জাবী পড়তে হয় শামীম ওসমানকে
স্পেশাল করেসপনডেন্ট || নিউজ নারায়ণগঞ্জ ০৬:১২ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০২০ বুধবার

নতুন প্রজন্মকে কলেজে যাওয়ার প্রথম দিনের স্মৃতি স্মরণ করে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমান বলেন, ‘আমি যেদিন প্রথম কলেজে যাই সেদিন জিন্সের প্যান্ট জিন্সের শার্ট পড়েছিলাম। আমার খালা ইন্ডিয়া থেকে জিন্সের প্যান্ট নিয়ে এসেছিলেন। তখন ফ্যাশন ছিল বাবরী চুল। আমি যখন রওনা দেই তখন আমার বাবা আমাকে ডেকে এসব খুলত বলেন। ওই সময়ে আমার বড় বোন আমাকে প্যান্ট আরা একটি সাদা পাঞ্জাবী পড়িয়ে দেয়। আমার তখন মনো হলো গ্রাম থেকে আসা সদ্য নেমে আসা ছেলে। তখন আমার বাবা আমাকে ডেকে বলেছিলে, আমি জানি তুমি এক সময়ে রাজনীতিতে আসবে। কিন্তু তোমার রাজনীতি ও জীবন এমনভাবে গড়তে হবে যাতে তোমার বাবা ও দাদার নাম কেউ না জানে। ক্লাশের নিরীহ ছেলেটা যেন তোমার সঙ্গে মিশে। এবং সেটাই তখন হয়েছিল। এখন কিন্তু সেটা নাই।
বেসরকারী টিভি চ্যানেল নাগরিক টিভির আধঘণ্টার গল্পে শামীম ওসমান এসব কথা বলেন। ২০ অক্টোবর সেটা প্রচারিত হয।
প্রসঙ্গত শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলী ১৯০০ সালে তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। ত্রিশের দশকে তিনি নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসা শুরু করে স্থায়ী হন। খান সাহেব ওসমান আলীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৪৬ সালে, তৎকালীন ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহর জামানত বাজেয়াপ্ত করে এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৩৫ সালে খান সাহেব ওসমান আলী নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া রেললাইন সংলগ্ন স্থানে গড়ে তোলেন ঐতিহাসিক বায়তুল আমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পদচারণে সিক্ত এ ভবনটিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে একাধিকবার এ বায়তুল আমানের কথা উল্লেখ আছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু বার বার খান সাহেব ওসমান আলীর কথাও লিখেছেন।
১৯৭১ সালে খান সাহেব ওসমান আলী মারা যান। অবশ্য তাঁর মৃত্যুর আগেই সত্তরের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি একেএম শামসুজ্জোহা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও সে সময় তিনিই প্রথম নিজ গাড়িতে ইংরেজির বদলে বাংলা নম্বরপ্লেট ব্যবহার করেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতে বাংলাদেশের ত্রাণশিবিরে তার মমত্ত্ববোধ ও ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আটক থাকা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের মুক্ত করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ১৯৭০ সালে গণপরিষদ সদস্য ছাড়াও ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মারা যান শামসুজ্জোহা। মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত এ কে এম শামসুজ্জোহার জন্ম নারায়ণগঞ্জে।
পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর গ্রেফতার হন শামসুজ্জোহা। ওই বছরের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যার সময় প্রয়াত জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সঙ্গে একই সেলে বন্দি ছিলেন। তার স্ত্রী মরহুমা বেগম নাগিনা জোহাও ভাষাসংগ্রামী ও `রতœগর্ভা`।
তার মেজ ছেলে এ কে এম সেলিম ওসমান বিকেএমইএর সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি এবং ছোট ছেলে এ কে এম শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি। বড় ছেলে মরহুম এ কে এম নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি ছিলেন।
তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট শামীম ওসমান। আশির দশকের শুরুর দিকে তোলারাম কলেজে ছাত্রলীগ দিয়ে শামীমের রাজনীতি শুরু। ১৯৮১ সালেই তিনি ওই কলেজের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী লীগের নারায়ণগঞ্জ শহর ও জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শামীম সাংসদ নির্বাচন হন। এছাড়া ২০১৪ ও সবশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনেও তিনি এমপি নির্বাচিন হন।
একেএম শামসুজ্জোহার জীবদ্দশাতেই তাঁর বড় ছেলে নাসিম এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে সাংসদ হন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সাংসদ হন তিনি। ২০১৩ সালের ৩০ জুন তিনি মারা যান। ওই বছরের উপ নির্বাচন ও সবশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি জাতীয় পার্টি হতে নির্বাচিত হন।
গত কয়েক বছর ধরেই নারায়ণগঞ্জে নানাভাবে সক্রিয় শামীম ওসমানের একমাত্র ছেলে অয়ন ওসমান। কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি শামীম ওসমানের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন।
অয়ন ওসমানের উদ্যোগে করোনাকালীন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যক্রম, সরকারি তোলারাম কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য ওয়াইফাই জোন, মেধাবী শিক্ষার্থী যারা অর্থাভাবে লেখাপড়া করতে পারছিল না তাদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান বেশ আলোচিত ছিল।
রাজনীতি প্রসঙ্গে শামীম ওসমান বলেন, প্রয়োজন হলে রাজনীতি ছেড়ে দিব কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথানত করবো না। আমি ক্ষমতায় থাকতেই ক্ষমতা ছেড়ে দিব। আমি যদি বুঝি দল ও নেত্রীর উপর কোন আঘাত আসবে না তাহলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাজনীতি ছেড়ে দিব। আমার কাছে মন্ত্রী হওয়া বড় ব্যাপার না। আমার চেয়ারটা চাই মানুষের হৃদয়ে। বেঁচে থাকা সময়ে অনেকেই তেল মারে। আমি চাই মৃত্যুর পর যেন মানুষ কাঁদে।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের কারো সঙ্গে আমার কোন দ্বন্দ্ব নাই। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এক। কিছু কিছু ব্যক্তি আছে যারা প্রধানমন্ত্রী ও সরকারকে গালি দিচ্ছে, উৎখাতের চেষ্টা করছে, আগেও বলেছে এখনও বলছে তাদের আমি পছন্দ করি না। আমি যখন দেখি জামায়াতের বড় নেতা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে বক্তব্য দিচ্ছে যে কাকে কেন কোন ওখানে দেওয়া হয়েছে প্রটেক্ট দেওয়ার জন্য। এখন বেশী প্রবলেম। বেশী কে খারাপ ছিল গোলাম আজম নিজামী নাকি খন্দকার মোস্তাক। কারণ নিজামী জামায়াতকে তো আমরা চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু খন্দকার মোস্তাকেরা তো পেছনের দরজা খুলে দিয়েছিল। পেছনের দরজা খুলেছিল বলেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। সে হিসেবে আমার কাছে মোস্তাকেরা খারাপ। তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
তবে অয়ন ওসমানকে এখনই রাজনীতিতে আনতে নারাজ শামীম ওসমান। তিনি বলেন, এখন যে রাজনীতি যেটা হচ্ছে সেই রাজনীতিতে আমার ছেলেকে বলেছি এখন না। আমি নিজেও চাই না। তার বয়স এখন ৩১। ও যদি ৪০ বছর বয়সে রাজনীতিতে করতে আসে তাহলে আমারও বয়স হয়ে যাবে অনেক। আপারও বয়স হয়ে যাবে। আমার দেখতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি আল্লাহ পাক আপার হায়াত রাখেন তাহলে তুমি রাজনীতিটা করতো পারো। আমার কথা হলো এনাফ। অনেক হয়েছে। আমি চতুর্থ প্রজন্মকে চাই না। কারণ আগের রাজনীতি এখন নাই। মাঠ থেকে রাজনীতি চলে গেছে। এ সময়ে প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নতি। এখন কিছু করতে হলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হও যাতে রাজনীতিতে নিজেকে বিক্রি করতে না হয়।’
শামীম ওসমান আরো বলেন, আমি থাকি রাস্তায় হকারদের সঙ্গে, চায়ের দোকানে বসি। এলাকার পাগলেরা আমার নাম জানে। আমি প্রচুর পাগলকে চিনি। তারাও চিনে। আপনারা দেখলে পালাবেন। তারা দৌড়ে আসে আমার কাছে। আমার জন্য তারা পাগল। আমি রাজনীতির মানুষ স্টুডিও বা বাসাতে যেভাবে বলি তাদের সঙ্গে সেভাবে বললে তো আমার কাছে আসবে না।
সালমা লিপির সঙ্গে বিয়ের ইতিহাস স্মরণ করে সাক্ষাৎ, প্রেম ও বিয়ের গল্প শোনান শামীম ওসমান। এ প্রসঙ্গে শামীম বলেন, ৩৩ বছরের সংসারের পর বলবো আমার ভালোবাসা সঠিক ছিল। তখন যতটা ভালোবাসতাম এখনো ভালোবাসি। আমার স্ত্রীর সম্প্রতি করোনা হয়েছিল। তখন তার মন খারাপ ছিল। কিন্তু আমি তার থার্মোমিটার মুখে নিয়েছি, তার গ্লাসের পানি মুখে নিয়েছি। যদিও আমার করোনা হয়নি। জীবন সঙ্গীনি ভালো পাওয়া কপালের ব্যাপার। পলিটিশিয়ানের স্ত্রী কেউ হতে চায় না।’